হোম জাতীয় শিশু হত্যা : যেভাবে মূল আসামিদের পাশ কাটিয়ে রিকশাচালকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ

শিশু হত্যা : যেভাবে মূল আসামিদের পাশ কাটিয়ে রিকশাচালকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 256 ভিউজ

নিজস্ব প্রতিবেদক :

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির। ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেসবুকে নিজের ব্যক্তিগত ওয়ালে লিখে যাচ্ছেন নিরপরাধ ব্যক্তিদের কীভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়ানো হলো। দ্বিতীয় পর্বে লিখেছেন কক্সবাজারের এক ধনী পরিবারের শিশুকে অপহরণের পর টাকার জন্য কীভাবে হত্যা করা হয়; কীভাবে মূল আসামিদের পাশ কাটিয়ে এক রিকশাচালককে মামলায় জড়ানো হয়। এ ঘটনার বর্ণনা ছিল শিউরে ওঠার মতো, যা পড়ে জানা যায়, কীভাবে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে খুনের মামলায় জড়ানো হলো। পড়ুন আইনজীবী শিশির মনিরের বর্ণনায়-

১। গতকালের পর্বে বলেছিলাম অসহায়-দরিদ্র মানুষদের আইনি সেবা প্রদানের কথা। এরই অংশ হিসেবে নবাব আলী ভাই এ মামলাটিও নির্ধারণ করেন। এদের কোনো আইনজীবী ছিল না। জেল থেকে জেল আপিল দায়ের করেছিল। পেপারবুক সংগ্রহ করে আমরা পড়াশোনা শুরু করলাম। আমার জুনিয়র সাকিবকে রিসার্চের দায়িত্ব দিলাম। সে অনেক পড়ুয়া এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে রিসার্চ করতে পারে। দশ-বারো দিন ধরে খোঁজাখুজি করল। মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতাম, সাকিব ‘খবর কী?’ সে মুচকি হাসি দিত। আমি বুঝতে পারতাম—এখনও কিছু পায়নি। এভাবে বেশ কিছুদিন গেল। মামলাটির সিরিয়াল আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। আমরাও প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।

২। একদিন বিকেলে কোর্ট থেকে চেম্বারে ফিরলাম। আসরের নামাজের পর সাকিব পেপারবুক নিয়ে রুমে এলো। আঁচ করলাম কিছু একটা পেয়েছে। সে বলল, ‘ভাই, এটা তো খালাস হবে!’ আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম। ‘ধুর, বল কী?’ সে বলল, ‘দেখবেন, আমি বলছি, খালাস হবে।’ ‘কেন বলছ এই কথা?’ উত্তরে বলল, দুই জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আছে। একজন আরেকজনকে দোষ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কেউ নিজের দায় স্বীকার করেনি। আমি বললাম, ‘শুধু এজন্য খালাস পাবে?’ আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। বললাম, ‘আরও দেখো? ভালোভাবে দেখো।’ সে বলল, ‘জি।’

৩। যতটুকু মনে পড়ে দুই/তিন দিন পর বাদ মাগরিব আবার সে রুমে এলো। এবার অট্টহাসি হাসছে। তার হাসার ভঙ্গি অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমি আঁচ করলাম—কিছু একটা পেয়েছে। রুমে ঢোকার সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সুখবর আছে?’ জবাবে বলল, ‘আছে।’ নিজ থেকেই শুরু করল, ‘ভাই, এটা কীভাবে হয়? স্কুল থেকে বাচ্চাকে নিয়ে গেছে, অথচ স্কুলের দারোয়ান-শিক্ষক-সহপাঠী-অভিভাবক কেউই সাক্ষী নাই। এই মামলায় খালাস ছাড়া আর কী হবে?’ বললাম, ‘আরও দেখো। শুধু আবেগ দিয়ে তো আর খালাস হবে না। আইনি point বের করো।’ সে কিছুটা বিরক্ত হলো। এবার সে জিদ হিসেবে নিল। বলল, ‘আমার সন্দেহ হয়। এই ধরনের ঘটনা হতে পারে না। কিছু একটা বের করবই।’ তার জেদ দেখে আমি মুচকি হাসলাম। এই ধরনের জেদবোধ আইন পেশায় খুবই জরুরি বিষয়। সঠিক আইন খুঁজে বের করার জন্য প্রয়োজন তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও জেদি মনোভাব। অন্যথায় জটিল মামলায় হার অনিবার্য।

৪। এরই মধ্যে মামলাটি শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় এলো। প্রথমেই রাষ্ট্রপক্ষের পালা। নবাব আলী ভাই ও সাকিব বসে থাকত, আর নোট নিত। আমি মাঝে মাঝে যেতাম। আদালত কী কী প্রশ্ন করতেন, দিনশেষে সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। এভাবে পেপারবুক পড়া শেষ হল। সাকিব বলল, ‘ভাই, বিষয়টি বেশ জটিল।’ নবাব আলীকেও চিন্তিত দেখতাম। আমি সাহস দিতাম। যদি মিথ্যা ঘটনা হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই কিছু না কিছু বের হবেই। এটাই মিথ্যার ধর্ম। মিথ্যা কথা বলে শেষ পর্যন্ত মেলানো যায় না।

৫। কোর্টের প্রশ্ন ও রাষ্ট্রপক্ষের আলোচনার সময় আমরা ইস্যু বুঝতে পারলাম। সেই আলোকে তিন/চার দিন ধরে আমরা LCR (নিম্ন আদালতের রেকর্ড) দেখতে লাগলাম। প্রায় হাজার পৃষ্ঠা। ধুলায় ভরপুর। পাতাগুলো প্রায় ছেঁড়া ছেঁড়া অবস্থা। হাত দিয়ে ধরলেই যেন আরও ছিঁড়ে যাবে। তবুও মাস্ক পরে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ করে একটি বিষয় চোখে পড়ল। পুলিশ খালেককে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। এই মর্মে একটা মেডিকেল রিপোর্টও আছে। এটা কেন? কেন পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করবে? পুলিশ ফরওয়ার্ডিং কী বলে? কী হয়েছিল খালেকের? কী কারণে ভর্তি করা হলো? বিস্তারিত তথ্য কোথায় পাব? পরিবারের কাউকে তো আমরা চিনি না। কোনোদিন কাউকে দেখি নাই। আসামিও দেখি নাই। তার আত্মীয়-স্বজনদের দেখি নাই। বিষয়টি বেশ রহস্যজনক মনে হলো। আরও খুঁজতে লাগলাম। এ যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হচ্ছে। পুলিশ ফরওয়ার্ডিং-এ পাওয়া গেল মজার তথ্য। পুলিশ স্বীকার করছে—গ্রেপ্তারের সময় ধস্তাধস্তিতে খালেক আহত হয়। সেজন্য তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয় এবং খালেক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। এই তথ্যটা পেয়ে কিছুটা স্বস্তিবোধ করলাম। আরও খুঁজতে লাগলাম। আরও কিছু দরকার। আরও চাই। শুধু এতটুকু দিয়ে হবে না। আরও গভীর সাধনা প্রয়োজন। প্রয়োজন অন্তরচক্ষু দিয়ে দেখা। আলোচনা করতে লাগলাম। চেম্বারের আরও কয়েক জন জুনিয়রকে কাজ দিলাম। বিশেষ করে মোনায়েমকে বললাম, ‘তুমিও দেখ।’

৬। এবার আমাদের পালা। তখনও আমরা clear case তৈরি করতে পারিনি। কোনো ধরনের bundle-ও প্রস্তুত করা হয়নি। আদালতের প্রশ্ন ও পরিবেশ দেখে পরবর্তী রিসার্চ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবার ঘটনাটি একটু করে বলছি। বুঝতে সুবিধা হবে। কক্সবাজারে একজন ধনী/প্রভাবশালী মানুষের সন্তানকে স্কুল থেকে অপহরণ করা হয়। শহরজুড়ে মাইকিং করেও কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নাই। কে বা কারা মোবাইলে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করে। বেশ টাকাপয়সা দাবি করে। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় শিশুটিকে মেরে ফেলে। পরদিন সৈকতে লাশ পাওয়া যায়। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সকালে ঝাড়ু দিতে গিয়ে লাশের সন্ধান পায়। লাশ উদ্ধার করে মর্গে নিয়ে পোস্টমর্টেম করা হয়। ভেতরে বালি ও পানি পাওয়া যায়। এই ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে শিশুর চাচাসহ অন্যান্যদের আসামি করে মামলা করা হয়। তাদের পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এই ঘটনা ঘটেছে মর্মে এই মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ তদন্ত করে পরিবারের সবাইকে অব্যাহতি প্রদান করে। অপর তিন জনকে গ্রেপ্তার করে, যাদের নাম এজাহারে ছিল না। একজন রোহিঙ্গা খালেক। সে রিকশা চালাত। অপর দুই জন কক্সবাজারের গরিব মানুষ। এক জন মোবাইল ফোনকলের ভাসমান দোকানদার। আরেক জন রিকশাচালক। খালেকসহ দুই জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। নিজেদের দোষ আংশিকভাবে স্বীকার করে। নিম্ন আদালত ১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন। যুক্তিতর্ক শেষে দুই জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন ২০১৫ সালে। এই মামলা শুনানির জন্য ২০২১ সালে হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আসে।

৭। আমি দাঁড়িয়েই বললাম ‘My Lords! This is a clear case of acquittal. The prosecution couldn’t prove its case beyond reasonable doubt. They are the victims of the circumstances and their confessional statements have been obtained by coercion and torture. Further, in the body of their confession, one person accused another avoiding his guilt. This type of confession cannot be taken into consideration by your Lordships.’

জজ সাহেবেরা বললেন, ‘কী বলেন আপনি, টাকার জন্য বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছেন। আবার বলছেন, খালাসের মামলা? দেখান দেখি কেন খালাস পাবেন? কেন খালাস দেব? একজন আরেকজনকে দোষ দিচ্ছেন? দুটি মিলিয়ে পড়লে দেখা যায়—আপনারা দুই জনই দোষী? এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবেন? আপনি বলছেন আপনাকে torture করছে? কে করেছে? কখন করেছে? দেখাতে পারবেন?’

৮। আমি আদালতের প্রশ্নগুলো বুঝে গেলাম। ভাবলাম, এই দুটি বিষয়ই এই মামলার মূল কথা। অন্য কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নাই। জুনিয়রদের নোট নিতে বললাম। আদালতকে বললাম, ‘ইনশাআল্লাহ আমি আপনাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারব।’ এই কথা বলে স্বীকারোক্তিমূলক দুটি জবানবন্দি বারবার পড়ে শোনালাম। কিন্তু, সন্তুষ্ট করতে পারলাম না। আজকের মতো আদালত বিরতি হল। ঐদিন ছিল বৃহস্পতিবার। শুক্র-শনিবার বন্ধ। কিছুটা সময় পেলাম। সবাইকে নিয়ে আলোচনা করলাম। সাতটি নজির দিয়ে রিসার্চ bundle প্রস্তুত করল সাকিব। চার কপি তৈরি করল। রোববার সকালের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো।

৯। ১০টা ৫৫ মিনিটে আদালত উঠল। এক নম্বর আইটেম। আইটেম ডাকার সাথে সাথে আমি ডায়াসে গেলাম। সবাইকে Bundle-এর কপি দিলাম। জজ সাহেবেরা মুচকি হাসলেন। বললাম, ‘My Lords, I strongly and forcefully submit that these two confessions have been obtained by coercion and torture. Moreover, the concerned magistrate violated provision of law during recording confessional statements. Hence your Lordships, cannot take these confessions into your consideration. Apart from these two confessions, there is no other evidence to sustain conviction and sentence and hence they are liable to be acquitted by this Hon’ble Court.’

জজ সাহেবেরা অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনার argument-এর সমর্থনে প্রমাণ দেখান।’ বললাম, ‘অবশ্যই দেখাব। আমার argument দুটি। এক. নির্যাতন করে এই স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে; দুই. ম্যাজিস্ট্রেট আইন ভঙ্গ করেছেন।’

এক. নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়

‘My Lords. Kindly একটু রেকর্ডটা দেখেন।’ সবাই রেকর্ড হাতে নিলেন। ‘দয়া করে ৭৭ নম্বর পৃষ্ঠা দেখেন।’ জজ সাহেব বললেন, ‘কী দেখাবেন?’ ‘দেখেন কীভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের একটি মেডিকেল সার্টিফিকেট। লেখা আছে Assault.’ জজ সাহেব বললেন, ‘কে আপনাকে assault করল? বললাম, ‘এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য দয়া করে ১০৮ নম্বর পৃষ্ঠা দেখেন।’ গেলেন ১০৮ নম্বর পৃষ্ঠায়। সেখানে দেখা গেল, পুলিশ বলছে—গ্রেপ্তারের সময় ধস্তাধস্তিতে আহত হয় এবং তারাই হাসপাতালে ভর্তি করে। ‘আরও দেখেন, গ্রেপ্তারের সময় কত জন পুলিশ ছিল? আট/দশ জন পুলিশ অস্ত্র, গাড়িসহ হাজির ছিল। একজন ব্যক্তি ৮/১০ জন অস্ত্রধারী পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি করেছে? অতঃপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়েছে!! এই ধস্তাধস্তিতে পুলিশের কেউ আহত হয় নাই!! এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা!! আমরা এটা বিশ্বাস করব? আপনারা করবেন?’ পিনপতন নীরবতা। কোনো কথা নাই। জজ সাহেবেরা মাথা নাড়লেন। আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। খানিকপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এবার বলেন, এই পুলিশ ফরওয়ার্ডিং আমরা দেখতে পারি কি না? আইনের কোথায় আছে? কী বিধান আছে?’ বললাম, ‘অবশ্যই পারেন My Lords. It’s part of the case record. Then I read over section 3 of the evidence act and found a term ‘matters before it’, which indicates forwarding is a matter before you. Your Lordships can very much consider it.’ তবুও বললেন, ‘একটা সিদ্ধান্ত দেখান।’ বললাম, ‘কাল দেব।’ যথারীতি পরের দিন দেখালাম। জজ সাহেবেরা হাসলেন।

দুই. ম্যাজিস্ট্রেট আইন ভঙ্গ করেছেন

“দুটি বিষয় দেখাব। স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার সময় এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নাম দেখেন। একই ব্যক্তি একই সময়ে দুই জনের স্বীকারোক্তি রেকর্ড করছেন। এটি কীভাবে সম্ভব? এজন্য দুটি জবানবন্দি হুবহু মিলে গেছে। বিচারক কীভাবে এই কাজ করেন? তাকে show cause করা উচিত। তিনি Criminal Rules and Orders violate করেছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো দেখেন, হাতের লেখা কাটাকাটি আছে। তাকে নির্যাতন করা হয়েছে কি না? এই প্রশ্নের জবাবে প্রথমে লিখেছেন ‘হ্যাঁ’। তারপর কেটে লিখেছেন ‘না’। কে কাটল এটি? কেন কাটল? কার হাতের initial? এটা তো Fraud.” বলতে বলতে পরিস্থিতি বেশ সুনসান হয়ে গেল। ‘বিচার বিভাগীয় fraud has been practiced upon me. আমি রিকশাচালক। আমার ক্ষেত্রে এটি করা যায়। ধনীর দুলাল হলে কোনোভাবেই সম্ভব হতো না My Lord. বিচারের ভার আপনাদের ওপর রইল। ওপরে আল্লাহ আর জমিনে আপনারা। আমি মনে করি, এই মামলায় কিছুই নাই। বেকসুর খালাসই একমাত্র পথ।’

১০। রাষ্ট্রপক্ষকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জিএজি সাহেব কিছু বলবেন?’ তেমন কিছু বলতে পারলেন না। কিছুটা নীরব থাকলেন। তিনি অত্যন্ত ভদ্রলোক। অযথা কথা বলা পছন্দ করেন না। তাই নীরব থাকলেন। এক সপ্তাহ পর রায়ের তারিখ দিলেন (আদালত)।

১১। রায়ের দিন খুব চিন্তা হচ্ছিল। কী হবে? এত বড় একটা ঘটনা। চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। পরিবেশ কী বলে? খালাস পাব কি না? ইত্যাদি মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল বারবার। সকালে সবাই গিয়ে বসলাম। ১০টা ৫৫ মিনিটের দিকে জজ সাহেবেরা এলেন। সবাই নীরব। আইটেম ডাকা হলো। বড় জজ সাহেব পড়ে শোনালেন, ‘We have perused all the evidences and documents relating thereto. The judgment of the trial court is set aside. All the convict-appellants are acquitted from the charge. They should be set at liberty if not wanted in any other case.’ রায় শুনে খুশিতে চোখ ছলছল করে উঠল। আমি উঠে গিয়ে ‘Much Obliged’ বললাম। বড় জজ সাহেব বললেন, ‘ভালো argument করেছেন। Convincing argument.’

১২। এই খালেক কে? কী তার পরিচয়? কে তার আত্মীয়? কেনই বা আসামি, কিছুই আমরা জানতাম না। মামলার রেকর্ডের বাইরে কোনো তথ্য আমাদের জানা ছিল না। এই রায়ের খবর পত্রিকায় আসার অনেক দিন পর জেল থেকে একজন কল করল। বলল, ‘স্যার, আমি জেল থেকে বলছি। আমি কক্সবাজারের খালেক। আপনি আমার বাবার কাজ করেছেন। আমার চামড়া বিক্রি করেও এই ঋণ শোধ করতে পারব না। আমি বের হয়েই আপনার সাথে দেখা করব স্যার।’ আমিও আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। বেশি কথা বলতে পারলাম না। শুধু তার কথা শুনলাম।

১৩। রায়ের ৪৩ দিন পর হঠাৎ একটা নোটিশ পেলাম। সরকারপক্ষ চেম্বার জজের আদালতে আপিল দায়ের করেছে। হাইকোর্টের আদেশ স্টে চেয়েছেন। শুনে মনটা বেশ খারাপ হল। তবুও খবর রাখলাম। শুনানির দিন মাননীয় চেম্বার জজ আদালত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করলেন। খালেক আর বের হতে পারল না। সে এখনও মৃত্যুর সেলে আছে। ইনশাআল্লাহ আপিল বিভাগে আরেকটা fight দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে। আইনজীবী হিসেবে অর্ধেক রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া যায় না। শেষ দেখতে হয়।

১৪। গত বছরের শেষের দিকে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ একজন নারী ফোন করে পরিচয় দিলেন, তিনি খালেকের বোন। আমার সাথে দেখা করতে চান। হোটেলে আসতে বললাম। দই ও মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির। বললাম, ‘আপনার ভাই তো এখনও মুক্তি পায় নাই। সুপ্রিম কোর্ট স্টে করে দিয়েছে। অনেক সময় লাগবে।’ বলল, ‘স্যার, আপনি আমাদের জন্য এত কিছু করেছেন! বাকিটাও করবেন স্যার। প্রথমে শুনে আমরা বিশ্বাস করতে পারি নাই। জীবনে কোনোদিন কেউ কাউকে দেখি নাই। আপনিও দেখেন নাই আমাদের। আমরাও দেখি নাই আপনাদের। আমরা নির্যাতিত স্যার। আমাদের বাড়িঘর সব ভেঙে দিয়েছে। এই মামলার পর সব দখল করে নিয়েছে। আমাদের সাহায্য করেন স্যার।’ বললাম, ‘আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাব। দোয়া করবেন।’ এই কথা বলে বিদায় নিলাম। খেয়াল করলাম, যতক্ষণ দেখা যায়, ততক্ষণ খালেকের বোন অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিল।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন