শিপলু জামান, ঝিনাইদহ :
ঝিনাইদহের হরিশংকরপুর গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় বাঁশ কাটার ঠুকঠাক শব্দ। কেউ মাটি দিয়ে ভরাট করে ঘরের মেঝে সমান করছেন, আবার কেউ ঢেউটিন দিয়ে চাল তৈরি করছেন। গ্রামের তিন শতাধিক মানুষ প্রায় দেড় বছর ধরে হামলা ও সহিংসতার ভয়ে গ্রামছাড়া ছিলেন। ইউপি নির্বাচন নিয়ে বিরোধে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনার জেরে প্রতিপক্ষের লোকজন তাঁদের শতাধিক পাকা, আধা পাকা ও টিনের ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।
গ্রামে ফেরা কয়েকজন বলেন, দীর্ঘ ১৮ মাস গ্রামছাড়া থাকার পর বাড়ি ফিরে অনেকের নিজের বাড়িটি চিনতে কষ্ট হয়েছে। বসভিটায় জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। রাতে ঘুমানোর কোনো জায়গা নেই। হাতে পয়সাও নেই যে নতুন ঘর করবেন। মানুষের দেওয়া চাল-ডাল দিয়ে রাতে একবার রান্না হচ্ছে, বাকি দুই বেলা বিস্কুট ও চিড়া-মুড়ি খেয়ে কাটাতে হচ্ছে। তাঁদের এখন ঘর সংস্কার ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সামাজিক বিরোধে গত বছরের ৪ জুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর ইউনিয়নের আলাপ শেখ ও নুর ইসলাম খুন হন। এ ঘটনার পর গোটা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে এক পক্ষের লোকজনের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। সবচেয়ে বেশি হামলা হয় হরিশংকরপুর গ্রামে। এই গ্রামের ৭২টি পরিবারের তিন শতাধিক মানুষ জীবন বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। তাঁদের বাড়িঘরে হামলা করে ভাঙচুর লুটপাট চালানো হয়। এরপর ঘরের ইটও খুলে নিয়ে যায় ওই পক্ষ।
হরিশংকরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য সালেহা খাতুন জানান, তাঁদের ইউনিয়নে দুটি সামাজিক দল রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদের ভোট নিয়ে এসব দলের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে এক পক্ষের নেতৃত্বে বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাসুম, অন্য পক্ষের নেতৃত্বে সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদ। তাঁরা দুজনই ক্ষমতাসীন দলের নেতা। আসন্ন নির্বাচনেও মাসুম নৌকার প্রতীক পেয়ে নির্বাচন করছেন। ফরিদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন। গত ৪ জুন খুন হওয়া আলাপ শেখ ও নুর ইসলাম খন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদের সমর্থক ছিলেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, এক বাড়িতে দাওয়াতের ঘটনা নিয়ে বিরোধে পাল্টাপাল্টি হামলায় আলাপ শেখ ও নুর ইসলাম খুন হন। এ ঘটনায় তিনিসহ (মাসুম) ২৫ জনকে আসামি করে মামলা হয়।
এদিকে দুজন খুন হওয়ার ঘটনার জেরে ৭২টি পরিবারের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে তাঁদের সবকিছু শেষ করে দেওয়া হয়। মাঠের জমিগুলো দখল করে নেয় প্রতিপক্ষ। এখনো তাঁরা (প্রতিপক্ষ) সেই জমি চাষাবাদ করছেন। আবার হামলা হতে পারে—এই আশঙ্কায় তাঁরা দীর্ঘ ১৮ মাস বাড়ি ফিরতে পারেননি।
হরিশংকরপুর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, পুলিশ প্রশাসনের আশ্বাসে গত ৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষগুলো বাড়ি ফিরেছেন। তবে তাঁদের অসহায় অবস্থা দেখে তাঁর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। প্রতিপক্ষ তাঁর পাকা ভবনও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এখন তাঁরা পাটখড়ি দিয়ে চালা বেঁধে সেখানে রাত কাটাচ্ছেন।
এ বিষয়ে হরিশংকরপুর ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী খন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদ জানান, তাঁর প্রতিপক্ষ বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাসুম এই হত্যাকান্ডের ইন্ধনদাতা। এ কারণে তিনি ওই ঘটনায় হওয়া মামলার আসামি হয়েছেন।
এ বিষয়ে হরিশংকরপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই ফারুক হোসেন জানান, ঘরছাড়া মানুষগুলো বাড়ি ফিরেছেন। তাঁরা ওই গ্রামের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে করতে সেখানে পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করেছেন।