হোম জাতীয় পশ্চিমবঙ্গের ভোটের মাঠ ও বাংলাদেশের রাজনীতি

থরতপ্ত বৈশাখের তীব্র দাবদাহের সাথে কোভিডের অস্বাভাবিক সংক্রমনের মধ্যে মানব মৃত্যু যখন মিছিলে রূপ নিচ্ছিল গোটা ভারতজুড়ে ,তখন পশ্চিমবঙ্গের ভোটের মাঠ ছিল আরও গরম। এই মাঠে কর্মী সমর্থক ও নেতানেত্রীদের সরব পদচারণা সবার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল। গত ২৭ মার্চ থেকে শুরু হওয়া বিধান সভা নির্বাচনে ৮ দফা ভোট গ্রহন শেষে বিধন সভায় নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কুর্সিতে তৃতীয়বারের মতো বসে শেষ হাসি হাসলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার দল তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২১৫ টি আসন। বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি পেয়েছে ৭৭ টি আসন। প্রার্থীর মৃত্যু জনিত শূন্যতার কারণে দুটি আসনে নির্বাচন হয়নি। ২৯৪ আসনের ওই দুটি বাদে ভোট হয়েছে ২৯২টিতে।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে এবার ভোটাভুটি হয়েছে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বনাম গেরুয়া শিবিরের মধ্যে। লড়াই হয়েছে জয় শ্রীরাম বনাম জয়বাংলা ও জয়হিন্দের মধ্যে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন এবার বামের ভোট রামে গেছে। এজন্য বিজেপি তার আগের সংখ্যা ৩ থেকে ৭৭ এ পৌছেছে। বলা যায় এতে তাদের ভোট বিজয় না হলেও রাজনৈতিক বিজয় হয়েছে। সংযুক্ত বাম মোর্চার ভোট ব্যাংক উজাড় হয়েছে পদ্মশিবিরে। সমালেচকরা বলছেন সংযুক্ত বাম মোর্চা তাদের স্বকীয়তাকে ধারণ করে ভোট করলে বিজেপির গেরুয়া শিবির হাতেগোনা দুই চারটি আসন নিয়ে ফিরে যেতো দিল্লীতে। সে ক্ষেত্রে বামমোর্চা ও তৃণমূলের মধ্যেই ভোটের লড়াপেটা হতো। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভোটাভুটি স্থান পেত না।

এবারের বিধানসভা নির্বাচনে উচ্চারিত কিছু কিছু কট‚বাক্যে সমালোচনার মুখে পড়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েকজন প্রার্থীরও কথা এবং আচরন রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্জিত হয়েছে । নরেন্দ্র মোদি ভোটের মাঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য করে কট‚ বাক্য ছুড়ে দিয়ে বলেছেন ‘দিদি গো দিদি, ও দিদি’ । এর জবাবে মমতা ব্যানার্জি বলেছেন হোগোল কুতকুত, কিম্ভূতকিমাকার ইত্যাদি। বিজেপি উচ্চারণ করেছে জয় শ্রীরাম । অপরদিকে তৃণমূল কংগ্রেস উচ্চারণ করেছে জয় বাংলা, জয়হিন্দ। ভারতীয় গনমাধ্যমে বিধানসভা নির্বাচনকালে বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে একটি ভিন্ন আসনে তৃনমূল কংগ্রেস আয়োজিত জনসভাস্থলে এসে নারীদের উদ্দেশ্যে অশোভন কথা বলার খবর প্রচার লাভ করেছে।

তৃনমূলের নারী কর্মীরা যখন মিছিল করছে তখন তিনি রাস্তা ফাঁকা করার কথা বলে গাড়ির মধ্য থেকে বলেছেন, বেশী বাড়াবাড়ি করলে গাড়িতে তুলে নেব কিন্তু। অভিনেত্রী পায়েল সরকার, তনুশ্রী চক্রবর্তী ও শ্রাবন্তী চক্রবর্তী বিজেপির হয়ে নির্বাচন করে হেরে গেছেন। তার পরই তাদের উদ্দেশ্য করে বিজেপির প্রবীন নেতা তথাগত রায় এই তিন নারী সম্পর্কে অশোভন উক্তি করে বলেছেন তারা দলের প্রাদেশিক নেতার সাথে প্রমোদ ভ্রমন করে বেড়িয়েছেন। এমনকি সেলফি তুলে প্রচার করেছেন। এসব নগর নটিদের কে দিয়েছে মনোনয়ন। কে বানিয়েছে প্রার্থী। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া শুভেন্দু অধিকারী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়কে মমতা বেগম আখ্যায়িত করে তাকে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে তুলনা করে বলেছেন তাকে খালেদার কাছে পাঠানো হবে।

তিনি বলেছেন মমতা ব্যানার্জি সঠিকভাবে চন্ডিপাঠ করতে না পারলেও তিনি নির্ভুল ভাষায় কলেমা পড়তে পারেন। শুভেন্দু অধিকারী তার বিধানসভা আসন নন্দীগ্রামে হিন্দু ও মুসলিম ভোটারদের পৃথকভাবে উসকে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধানোর চেষ্টা করেছেন বলেও ফেসবুকে মন্তব্য এসছে। এমনকি সংবাদ মাধ্যমেও তা ছড়িয়ে পড়ে। বিধানসভার আরামপুর কেন্দ্রে তৃনমূল প্রার্থী সুজাতা মন্ডলের বিরুদ্ধে গ্রামবাসী অভিযোগ করেন তিনি একজন নারীর হাতে আঘাত করেছেন এবং তার জ¦লন্ত চুলোয় রান্না করা খাবার দাবার লন্ডভন্ড করে দিয়েছেন। এমন সব অভিযোগ নিয়ে নারীপুরুষ মিলে সুজাতা মন্ডলকে লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া করে। সংবাদমাধ্যমে দেখা গেছে সুজাতা মন্ডল প্রাণভয়ে পালানোর জন্য ধানক্ষেত মাড়িয়ে দৌঁড়াচ্ছেন আর পেছনে ধাওয়া করেছে বড়বড় লাঠি হাতে বিজেপি সমর্থক কর্মীরা।

বিজেপি এবং তৃনমূল উভয় দলের বিজয়ী বিধায়কদের মধ্যে খুন, খুনের চেষ্টা, নারীর প্রতি সহিংসতা ধর্ষণ এবং নারীকে অপমান করার মতো অনেক অনেক ঘটনার মামলার আসামী রয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও। অপরদিকে শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে ৫ জন নিহত হবার খবর বিধানসভা নির্বাচনকে মলিন করে দেয়। বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী বিশেষ বিমানে করে ২১ বার পশ্চিমবাংলায় এসে বিজেপির প্রচার জনসভায় যোগ দিয়েছেন। অপরদিকে মমতা ব্যানার্জী ১৪০টি জনসভায় বক্তব্য রেখেছেন। এরই এক পর্যায়ে তিনি পায়ে চোট পেয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন।পরে পুরো সময়টা তিনি হুইল চেয়ারে বসে দলীয় প্রচার সভায় ভাষন দিয়েছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। তার পায়ে চোট লাগার বিষয়টিকে তাকে হত্যা চেষ্টা বলে তৃণমূল দাবি করলেও অন্যরা বলছেন এটা নিছক একটি দুর্ঘটনা।

পোল রাইটস গ্রæপ এসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস(এডিআর) নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তৃনমূল কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত ৩৪ শতাংশ এবং বিজেপি থেকে নির্বাচিত ৫১ শতাংশ বিধায়ক নানা ধরনের অপরাধের মামলার আসামী।
এবারের নির্বাচনে মাঠে সব বয়সের নারীর অংশগ্রহন লক্ষ্য করা গেছে। তারা খেলা হবে ¯েøাগান দিয়ে দিনরাত নির্বাচনী ময়দানকে সরগরম করে রেখেছেন। একই সাথে বিজেপি দাবি করেছে ক্ষমতায় আসতে পারলে তারা বাংলাকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবেন। অপরদিকে তৃনমূল বলেছে, তারা ক্ষমতায় যেতে পারলে নারীদের সুরক্ষা ও তাদের মর্যাদা আরও নিশ্চিত করে তাদের সহায়তা করবেন। বিজেপিতে যেয়ে হেরে যাওয়া অভিনেত্রীদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে তৃণমূল বিধায়ক নুসরাত বলেছেন, ভারতীয় জনতা পার্টি নারীদের প্রতি সবসময় অমর্যাদাকর আচরন করে আসছে। তারা নারীদের বারবার অপমান করেছে। এমনকি যারা তাদের নিজ দলের তাদেরও অপমান করতে ছাড়েনি বিজেপি। নারী প্রার্থীদের নগর নটি বলে বিজেপির তথাগত রায় নারী সমাজকে কলংকের চোখে দেখে নারী জাতির অপমান করেছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করে বলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মতুয়া ভোট পকেটে নেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে এসে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে অর্ঘ্য দিয়েছেন। তাদের সাথে মত বিনিময় করে তাদের ভোট নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া ২৭ মার্চ ভোট শুরুর প্রথম দিনেও সাতক্ষীরার একটি মন্দিরে পূজা দিয়ে সে এলাকা থেকে দেশত্যাগী বর্তমানে ভারতীয় মতুয়াদের ভোট নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মোদি, অমিত শাহ এবং শুভেন্দু অধিকারীকে নিশানা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন তারা সংখ্যালঘু মুসলিম, আদিবাসী এবং কোনো এক সময়ে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসা হিন্দুদের বিতাড়িত করবেন বলে কটাক্ষ করেছেন। তবে বিধানসভা নির্বাচন শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানাতে ভুল করেন নি। ভারতের ভোটের মাঠে শিষ্টাচার বহির্ভুত যে আচরন ও উচ্চারণ আমরা লক্ষ্য করলাম তা নিন্দনীয়। বলা বাহুল্য বিধান সভা নির্বাচনী মাঠে মোদি মমতা কেউই কিন্তু বাংলাদেশের সাথে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে একটি কথাও বলেন নি। পশ্চিমবঙ্গে ভোট পরবর্তী সহিংসতায় অন্ততঃ ২০ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলেও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রচার লাভ করেছে। তবে বিশে^র সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের এই রাজ্যে নির্বাচনকালে গনমাধ্যমগুলি পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেছে বলে বলা যায়।

ভারতীয় নির্বাচনী ময়দানে উচ্চারিত অনুচ্চারিত আচরণের বিপরীতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা সমীচিন বলে মনে হয়েছে। আমাদের দেশের নির্বাচনে এমনতর আচরণ সচরাচর লক্ষ্যনীয় নয়। আমাদের বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতার পালাবদল হবার আগে ও পরে যে সব সরব উচ্চারণ করে থাকে তার দুচারটি তুলে ধরতে চাই। আমাদের নেতা নেত্রী ও কর্মী সমর্থকদের মুখ থেকে আসে মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে কে ছিলেন না ছিলেন, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদকে কে তোষন করে না করে, সন্ত্রাস লালন করে কারা ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠে আসে।

আমাদের রাজনৈতিক মাঠে সরবভাবে উচ্চারিত হয় কোন সরকার আমলে সুখ ছিল সন্ত্রাস ছিলনা। কার সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কম অথবা বেশি ছিল। কথা ওঠে খুন খারাবি সন্ত্রাস মানবাধিকার লংঘন , ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে । কথা উঠে আসে খাদ্য কৃষি বিদ্যুত ও স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে। কার সময়ে রাস্তাঘাট সেতু কতোটা হয়েছে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা নির্মান সংখ্যা কতো এবং চাকুরি ও কর্মসংস্থান নিয়েও ফিরিস্তি তুলে ধরেন আমাদের নেতা নেত্রীরা। বাংলাদেশের রাজনিিততে ব্যাক্তি সমালোচনা খুবই কম, বরং রাজনৈতিক সমালোচনা বেশি। সেখানে শিষ্টাচার লংঘনের ঘটনা চোখে পড়া দুর অস্ত ব্যাপার। আমাদের জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে পাস্পরবিরোধী রাজনৈতিক সমালোচনা হয় বটে তবে সেখানেও শিষ্টাচার লংঘনের ঘটনা কালেভদ্রে চোখে পড়ে। তবে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে আমরা যা প্রত্যক্ষ করলাম তা কখনও প্রত্যাশিত নয়।

লেখকঃ সুভাষ চৌধুরী , সাবেক সভাপতি, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব। ০৭.০৫.২১

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন