ঝিনাইদহ অফিস :
চলছে আমনের মৌসুম। মাঠে মাঠে এখন দিগন্ত জোড়া খেতের ধান বাতাসে দোল খাচ্ছে। জাতের ভিন্নতায় ধানের আকার ও আয়ুষ্কালের পার্থক্য রয়েছে। সে কারণেই মাঠের কোন খেতের ধান পাকা, কোনটা আধাপাকা। কোনটা সবেমাত্র শিষ বের হচ্ছে আবার কোনটাতে এখনও সময় লাগবে। কিন্তু বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ব্রি-ধান ৭৫ ফলনে চমক সৃস্টি করেছে, যা কৃষকের ঘরে উঠতে শুরু করেছে। এ জাতের ধান চাষে কম খরচে অল্পদিনে অধিক ফলন পেয়ে কৃষকেরা বেজায় খুশি।
তাদের মধ্যে একজন ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের কৃষক শাহাজান মন্ডল। তিনি এ বছর দুটি খেত মিলে মোট ১৮ কাঠা জমিতে ব্রি-ধান ৭৫ চাষ করে এলাকার অন্য কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছেন। এখনই তিনি ওই জমিতে বোনাস ফসল হিসেবে ইচ্ছামতো রবিশস্যের চাষ করতে পারবেন এই ভেবে তার মনে দিচ্ছে খুশির দোলা। কৃষক শাহাজান মন্ডল উপজেলার কোলা ইউনিয়নের খড়িকাডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল খালেক মন্ডলের ছেলে। তার খেতের ধান দেখে অন্য কৃষকেরাও ঝুঁকছেন ব্রি-ধান ৭৫ চাষে। যে কারণে তার খেতের ধান বীজ হিসেবে সবাই পেতে চাচ্ছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৭০ হেক্টর। কিন্তু চাষ হয়েছে ১৮ হাজার ৪০০ হেক্টর। এর মধ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ব্র্রি-ধান ৭৫ চাষ হয়েছে ১৭৫ হেক্টর জমিতে। এ জাতের ধানের বীজ ২০১৮ সালে উদ্ভাবিত, যা সরকারি প্রনোদনা হিসেবে কৃষকদের বিনামূল্যে দেয়া হয়েছিল। সরেজমিনে শাহাজাহান আলী মন্ডলের একটি ধানখেতে গেলে দেখা যায়, ধান পেকে সোনালি রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। ধানের বাইল বা শিষ ধানের ভারে নুইয়ে পড়ছে। ধান দেখে কৃষক শাহাজান খেতে দাঁড়িয়েই তৃপ্তির হাসি হাসছেন।
শাহাজান মন্ডল জানান, মাঠে তার নিজের ৩ বিঘা চাষযোগ্য জমি আছে। আর বছরে ১২ হাজার টাকার চুক্তিতে আরও ৪ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে বিভিন্ন জাতের আমন ধানের চাষ করেছেন। এর মধ্যে কৃষি অফিস থেকে বীজ নিয়ে বর্গা নেয়া দুই দাগের ১৮ কাঠা জমিতে নতুন জাতের ব্রি-ধান ৭৫ চাষ করেছেন। এর মধ্যে ১১ কাঠার এক খন্ডের খেতের ধান কেটে মাড়াই সম্পন্ন করেছেন। তিনি জানান, ওই ১১ কাঠায় তিনি মোট সাড়ে ১৭ মণ ধান পেয়েছেন। রোপণের সময় থেকে ৭২ দিন সময় লেগেছে। আর এ জাতের ধানের বাকি আরেক খেতেই রয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে কেটে মাড়াই করবেন।
তিনি বলেন, নতুন জাতের ব্রি-ধান ৭৫ তাদের মাঠে এ বছরই প্রথম চাষ করেছেন। একই সঙ্গে রোপণ করা অন্য জাতের ধান সবেমাত্র বাইল বা শিষ বের হচ্ছে। অথচ ব্র্রি-ধান ৭৫ ঘরে উঠিয়ে এখন মসুর চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করতে বেশ সময় পাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, এ ধান রোপণের পর থেকে মাত্র একবার সার দিয়েছেন। আর রোগবালাই নেই বললেই চলে। কম উৎপাদন ব্যয়ে অল্প সময়ে ভালো ফলন পেয়েছেন। কৃষক শাজাহান আরও বলেন, তিনি বিগত ১৮ বছর ধরে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। সব মৌসুমেই তিনি ধানের চাষ করে থাকেন। কোন কোন বছর ফলন এত কম হয় যে উৎপাদন ব্যয় ঘরে আনাটাও কষ্ট হয়ে যায়। সেদিক বিবেচনায় বর্তমান সময়ে ব্রি-ধান ৭৫ সবচেয়ে কৃষকবান্ধব বলে মনে করছেন।
ফলে আগামীতে তিনি সব জমিতেই এ জাতের ধানের চাষ করবেন। ওই গ্রামের আরেক কৃষক জামাল হোসেন জানান, তাদের গ্রামের সারা মাঠেই এখন আমন ধান। কিন্তু কৃষক শাহাজান মন্ডলের খেতে নতুন জাতের ধান হয়েছে দেখার মতো। শুধু তাই নয়, তার ধানখেতের পাশ দিয়ে গেলে এ জাতের ধানের মিষ্টি সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আবার ফলনও ভালো। এখন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তার নিকট বীজের জন্য ধান কিনতে চাচ্ছেন। তিনি নিজেও আগামীতে এ ধানের চাষ করবেন। আর সবচেয়ে বড় কথা এ ধান চাষ করে সহজেই রবিশস্যের চাষ করা সম্ভব।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খন্দকার মোহায়মেন ইসলাম জানান, এ উপজেলার কৃষক শাহাজান মন্ডল একা নন এ উপজেলায় মোট ১৭৫ হেক্টর জমিতে ব্রি-ধান ৭৫ চাষ করা হয়েছে। এ ধানে উৎপাদন ব্যয় অনেক কম। অপেক্ষাকৃত কম দিনে সংগ্রহ করা যায়। ফলনও বেশি। তাই কৃষকদের দৃষ্টি এখন ব্রি-্র-ধান ৭৫ এর দিকে। কৃষি অফিসের মাঠকর্মীসহ কৃষকেরা সরাসরি এসেই এ ধানের ভালো ফলনের গল্প শোনাচ্ছেন। তিনি নিজেও কয়েকটি খেতে ধান দেখে প্রমান পেয়েছেন। ব্রি-ধান ৭৫ এর পাকা খেতের পাশে গেলে একটা মিষ্টি সুগন্ধ পাওয়া যায়। এটি সাড়া ফেলেছে কৃষকদের মাঝে। ফলে আগামীতে এ ধানের চাষ ব্যাপক হারে বাড়বে বলে তিনি মনে করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ঝিনাইদহের উপপরিচালক কৃপাংশ শেখর বিশ্বাস জানান, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ব্রি-ধান ৭৫ এর জাত উদ্ভাবন করে। এরপর ২০১৮ সালে সরকারিভাবে পরীক্ষামূলক চাষ শুর হয়। এ জাতের ধানবীজ কৃষকদেরকে প্রণোদনা হিসেবে দেয়ার পর কৃষকেরা চাষ করেছেন। ফলন ভালো পাওয়ায় এখন সাড়া পড়ে গেছে জেলাব্যাপী। তিনি বলেন, এ জাতের পাকা ধানখেতের পাশ দিয়ে গেলে মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায়। তাই এটাকে সুগন্ধি ধান বলা হয়। কম আয়ুষ্কালের ধান হওয়ায় কৃষকেরা ধান কেটেই আবার ভালোভাবে অন্য ফসল চাষের সুযোগ পাচ্ছেন। এখন থেকেই কৃষকেরা আগামী দিনের জন্য বীজ নিয়ে ভাবছেন। তিনি আরও বলেন, তাদের প্রদর্শনী প্লট থেকে বীজ সংগ্রহ করবেন। আর কৃষক পর্যায়ের খেতের ধানের বীজ সংরক্ষণের জন্য প্রযুক্তি সহযোগিতা নিশ্চিত করা হবে। কৃষকের হাসিতে সারা দেশ হাসে। আর এটা ভাবতেও ভালো লাগে বলে যোগ করেন এ কৃষিবিদ।