মোহাম্মদ আরীফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি :
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে ছিনতাই ও ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে থানায় মামলা করতে গিয়ে মাদক বিক্রির অভিযোগে মোছাঃ লাকী আক্তার (৩০) নামে এক গৃহবধূ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
লাকী আক্তার নামের ওই গৃহবধূ কুলিয়ারচর পৌর এলাকার তাতারকান্দি গ্রামের মোঃ রুকন মিয়ার স্ত্রী। ঘটনা ঘটে গত ১৫ জুলাই বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে।
গ্রেফতাকৃত ওই গৃহবধূকে কুলিয়ারচর থানা থেকে পুলিশ প্রহরায় বিজ্ঞ আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথে ওই গৃহবধূ সাংবাদিকদের বলেন, কুলিয়ারচর থানার কনস্টেবল মোঃ সাইফুল ইসলাম পুলিশ সদস্য পরিচয় দিয়ে ফোন করে তাকে বলেন, জরুরী ভিত্তিতে ২০ হাজার টাকা নিয়ে থানার পিছনের মাঠে তার সাথে দেখা করার জন্য। তা না হলে তার স্বামী ও তার সমস্যা হবে।
সাইফুলের ফোন পেয়ে রাত আনুমানিক ১০ টার দিকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে সাইফুলের সাথে দেখা করতে থানায় যাওয়ার পথে কুলিয়ারচর তিশা বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি স্থানীয় কয়েকজন ছেলে প্রথমে তার পথ রোধ করে। পরে তার গলায় ধারালো ছুরি ধরে তার সাথে থাকা মোবাইল ফোন, গহনা ও টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ধর্ষণের উদ্দেশ্যে পরনের বোরখা খুলে নেয় এবং জামা- কাপড় ছিড়ে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে।
এক পর্যায়ে সে তাদের হাত থেকে ছুটে দৌড়ে আত্মরক্ষার্থে “কে আছেন, কে আছেন, আমাকে বাঁচান আমাকে বাঁচান” বলে চিৎকার করতে করতে তিশা বাসস্ট্যান্ডে গেলে সেখানকার নাইট গার্ড আওয়াল মিয়া তাকে অর্ধ- উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাৎক্ষণিক স্থানীয় একটি খাবার হোটেল থেকে পুরাতন একটি গামছা নিয়ে ওই গৃহবধূর সম্ভ্রম ঢেকে কয়েকজন লোক দিয়ে ওই গৃহবধূকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
পরে ওই গৃহবধূ অন্য একজনের মোবাইল ফোন দিয়ে রাতেই বিষয়টি ৬নং ওয়ার্ডের স্থানীয় কমিশনার নূরে আলম সহ স্থানীয় সাংবাদিক আলী হায়দার শাহিন ও চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফয়সাল আহমেদকে জানান।
স্থানীয় সাংবাদিক আলি হায়দার শাহিন জানান, ওইদিন দিবাগত রাত ১২.৩৩ মিনিটের সময় তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন দিয়ে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ.কে.এম সুলতান মাহামুদকে বিষয়টি জানালে ওই গৃহবধূকে থানায় এসে অভিযোগ করতে পরামর্শ দেন ওসি।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে (অর্থাৎ ১৬ জুলাই শুক্রবার রাত ১টার দিকে) অভিযোগ করার জন্য স্থানীয় ৬ নং ওয়ার্ডের কমিশনার নূরে আলম তার ভাগিনা সহ কয়েকজন লোক দিয়ে ওই গৃহবধূকে কুলিয়ারচর থানায় অভিযোগ করতে পাঠান। ওই গৃহবধূ থানায় অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ অভিযোগ না নিয়ে উল্টো নাটকীয় ভাবে ওই দিন বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯ টার সময় উল্লেখ করে ৩০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার সহ তাকে আটক দেখিয়ে এবং রাত ১০.০৫ মিনিটে মাদক জব্দ দেখিয়ে তার নামে একটি মিথ্যা মামলা রুজু করে তাকে গ্রেফতার দেখিয়েছে বলে জানা যায়।
এই বিষয়ে তিশা বাসস্ট্যান্ডের নাইটগার্ড আওয়াল মিয়া (৫০) জানান, রাত আনুমানিক ১০ টার দিকে আমি ডিউটিরত অবস্থায় ছিলাম। হঠাৎ এক নারী অর্ধ- উলঙ্গ অবস্থায় আমাকে বাঁচান, বাঁচান বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে আসতে থাকে। পরে আমার কাছে আসার সাথে সাথে তাকে দেখে আমি প্রথমে একটি হোটেলে থাকা টেবিল মুছার পুরাতন গামছা দিয়ে সম্ভ্রম রক্ষা করি। পরে স্থানীয় কয়েকজন মুরুব্বি দিয়ে ওই নারীকে বাড়িতে পাঠাই।
এ বিষয়ে পৌরসভার স্থানীয় ৬ নং ওয়ার্ড কমিশনার ও প্যানেল মেয়র- ২ নূরে আলম বলেন, ঘটনার পর ওই নারী রাতেই আমাকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানালে আমি তার বাড়িতে যাই, তখন ঘটনা শুনে আমি ওই নারীর সাথে আমার ভাগিনা সহ কয়েকজন লোক দিয়ে থানায় অভিযোগ করতে পাঠাই। পরে জানতে পারি পুলিশ তার অভিযোগ আমলে না নিয়ে উল্টো মাদক মামলা দিয়ে বিজ্ঞ আদালতে চালান করে দিয়েছে।
গ্রেফতারকৃত গৃহবধূর স্বামী মোঃ রুকন মিয়া (৪৩) এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি আগে ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যবসা করতাম। একটি মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেল থেকে জামিনে এসে গত ৬ মাস যাবৎ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি। বর্তমানে আমি ভৈরবে জুতার ব্যবসা করি। এখন মাদকের ব্যবসা না করলেও দেখা যায় বিভিন্ন উৎসব ও ঈদ আসলেই কনস্টেবল সাইফুল বিভিন্ন ভাবে ফোন দিয়ে মামলা ও গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে আমাদের নিকট টাকা দাবী করে। টাকা দিতে না চাইলেই বিভিন্ন নাটক সাজিয়ে হেস্ত- নেস্ত করে। এই ভয়ে আমার স্ত্রী ২০ হাজার টাকা নিয়ে কনস্টেবল সাইফুলের কথা মতো থানার পিছনের মাঠে দেখা করতে যাচ্ছিলো। যাওয়ার পথেই ছিনতাই ও ধর্ষণের চেষ্টার কবলে পরে সে।
এ ঘটনায় পুলিশ মামলা না নিয়ে উল্টো আমার নামে ও আমার স্ত্রীর নামে মাদকের মামলা দিয়ে আমার স্ত্রীকে জেল হাজতে প্রেরণ করে। ওই দিন রাত ৯টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বাক্ষীদের জিজ্ঞেস করলে এবং কুলিয়ারচর থানার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই প্রমাণ হয়ে যাবে আমার স্ত্রীকে পুলিশ মাদকসহ আটক করে থানায় নিয়েছে না কি অভিযোগ করার জন্য আমার স্ত্রী লোক নিয়ে থানায় গিয়েছে। মামলার সঠিক তদন্তের জন্য থানার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংরক্ষণ করার জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করে এ ঘটনার সুষ্ট বিচার দাবী করে সে।
এ ব্যপারে কনেস্টেবল মোঃ সাইফুল ইসলামের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ফোন বন্ধ থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এই বিষয়ে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ.কে.এম সুলতান মাহামুদ বলেন, ওই মহিলা একজন মাদক ব্যবসায়ী, তার স্বামীও একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তাদের নামে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
এ সময় ছিনতাই ও ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে মামলা না নিয়ে মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছিনতাই ও ধর্ষণের চেষ্ঠার ঘটনাটি একটি সাজানো নাটক। মূলত ওই দিন রাতে তাদের একটি বাড়ি থেকে কয়েক লাখ ইয়াবা সেবনের দুইটি কয়েন উদ্ধার করি। সেই ঘটনা থেকে বাঁচতে এই নাটক সৃষ্টি করে সে।
উল্লেখ্য, গ্রেফতারকৃত ওই গৃহবধূর বিরুদ্ধে গত ১৬ জুলাই রাত ০২.২০ মিনিটের সময় কুলিয়ারচর থানায় দায়ের করা মামলা নং- ১১ এর বিবরণ থেকে জানা যায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ১৫ জুলাই বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯ টার দিকে পুলিশ অভিযান চালিয়ে পৌর এলাকার আশ্রবপুর সাকিনস্থ ভাংগা ব্রিজের দক্ষিণ পাশে মোঃ খোকন মিয়ার পরিত্যক্ত একটি বাড়ির উঠানে মাদক ক্রয়- বিক্রয়ের সময় ৩০পিছ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ ওই গৃহবধূ মোছাঃ লাকী আক্তার (৩০) কে আটক করে।
এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ী লাকী আক্তারের স্বামী মোঃ রুকন মিয়া (৩৫) দৌড়ে পালিয়ে যায়। অথচ ১৫ জুলাই বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ওই গৃহবধূ ছিনতাই ও ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হওয়ার পর ওই দিন ১৫ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে (অর্থাৎ ১৬ জুলাই রাত সাড়ে ১২টার দিকে) বিষয়টি অন্য একটি মোবাইলে ০১৯১২-১৩১২১৫ এই নম্বর থেকে ফোন করে স্থানীয় সাংবাদিক আলি হায়দার শাহিনকে এ ঘটনা জানান।
ঘটনা শুনে ওই সাংবাদিক ওই দিন রাত ১২টা ৩৩ মিনিটের সময় ফোন করে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ.কে.এম সুলতান মাহামুদকে জানালে ওসি ওই সাংবাদিককে বলেন, মহিলাকে বলেন থানায় এসে অভিযোগ করতে। পরবর্তীতে ওই গৃহবধূ ১৬ জুলাই শুক্রবার রাত ১টার দিকে থানায় অভিযোগ করতে গেলে ওই গৃহবধূর নিকট থেকে ৩০ পিছ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার দেখিয়ে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯ টায় আটক দেখায় পুলিশ।
মোবাইল ফোনের তথ্য অনুসারে ও সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওই দিন রাতে পুলিশের দায়ের করা মামলায় উল্লেখিত ঘটনাস্থল থেকে ওই গৃহবধূকে মাদকসহ আটক করেছে এমন কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।