হোম অন্যান্য ২৩ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা

২৩ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 42 ভিউজ

নিউজ ডেস্ক:
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক ও বর্তমান ২৩ জন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ৮ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল এই নির্দেশ দিয়েছেন।

আগামী ২১ অক্টোবরের মধ্যে তাদের গ্রেফতার করে ২২ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে সংঘটিত গুম ও খুনের ঘটনায় এসব কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ তদন্তে পাওয়া গেছে বলে ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বলা হয়েছে।

এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিচার সামরিক আদালতের বাইরে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় হয়েছে। এসব মামলায় তাদের কারও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, কারও যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। তবে কর্মরত অবস্থায় এত সংখ্যক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একসঙ্গে বাইরের আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর ঘটনা দেশের ইতিহাসে এই প্রথম। ফলে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের বিষয়ে বাহিনী কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে সেটা এখন বেশ আলোচিত বিষয়। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে আদালতের সোপর্দ করার দায়িত্ব কার তা নিয়েও চলছে আলোচনা। এ নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেনা আইন, ফৌজদারি আইন এবং ট্রাইব্যুনাল আইন। এমন পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত।

যেসব সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন তাদের মধ্যে সশস্ত্রবাহিনীতে কর্মরতরা হলেন- মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, কর্নেল কে এম আজাদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন।

এসব সেনা কর্মকর্তা বর্তমানে সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করলেও আগে তারা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরে (ডিজিএফআই) কর্মরত ছিলেন।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী (অব.), লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. আকবর হোসেন (অব.), মেজর জেনারেল মো. সাইফুল আবেদিন (অব.), লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সাইফুল আলম (অব.), লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী (অব.), মেজর জেনারেল হামিদুল হক (অব.), মেজর জেনারেল মোহাম্মদ তৌহিদ উল ইসলাম (অব.), লেফটেন্যান্ট কর্নেল মখছুরুল হক (অব.) ও লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আদেশ অনুযায়ী কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানতে চাইলে সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের অনেকেই মন্তব্য করতে রাজি হননি। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) থেকেও এ বিষয়ে কোনও ধরনের মন্তব্য কিংবা বক্তব্য দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেনাবাহিনীর দুই সাবেক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সেনা কর্তৃপক্ষের।

তাদের ভাষ্য, কোনও সেনা সদস্য যদি ফৌজদারি অপরাধে জড়িত হন, তাহলে তাকে প্রথমে সেনা কাস্টডিতে নেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে সেনা আইনের অধীন কোর্ট মার্শাল করা হয়। কোর্ট মার্শালে দোষী প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয় বা প্রয়োজনবোধে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সেনা আইনের বিধান অনুযায়ী, তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড হলে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সেনা হেফাজতেই রাখা হয়। তবে এর চেয়ে বেশি মেয়াদের সাজা হলে তাকে সাধারণ কারাগারে পাঠানো হয়।

তারা বলেন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের ওপর হামলার ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও বিচারপ্রক্রিয়ায় একই ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে, সেটি পুরোপুরি সেনা কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়।

নারায়ণগঞ্জে ২০১৪ সালে সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব-১১ এর তৎকালীন অধিনায়ক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ তিনজনকে প্রথমে সেনা আইনে আটক ও বিচার করা হয়। পরে তাদের চাকুরিচ্যুত করে বিচারিক আদালতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আদালত তারেক সাঈদসহ তিন সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তারা এখন কারাগারের কনডেম সেলে আছেন। এছাড়া, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসকে হত্যা চেষ্টা মামলায় পাঁচ সেনা কর্মকর্তাকে সামরিক আদালতে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়াও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এনএসআই ও ডিজিএফআই ও পুলিশের সাবেক প্রধানসহ বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিচার হয়েছে বিচারিক আদালতে।

এদিকে, গত ৬ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে কিছু সংশোধনী এনে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে সংশোধনীর বিষয়ে বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) থার্ড অ্যামেন্ডমেন্ট অধ্যাদেশ হিসেবে অভিহিত হবে এবং এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। অধ্যাদেশের ধারা ২০-বি এর পর নতুন একটি ধারা ২০-সি সংযোজন করা হয়েছে।

নতুন এই ধারার উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল হলেই তিনি আর জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এমনকি তিনি কোনও সরকারি চাকরিও করতে পারবেন না। এতে আরও বলা হয়, উপরিউক্ত উপধারা (১)-এ যা কিছুই থাকুক না কেন, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কোনও ব্যক্তি অব্যাহতি বা খালাসপ্রাপ্ত হলে ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই ধারা প্রযোজ্য হবে না। এছাড়াও কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেই ব্যক্তি সরকারি চাকরিজীবী হলে ওই পদে থাকতে পারবেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ট্রাইবুনালের আইন অনুযায়ী কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের বিচারে আইনগত কোনও বাধা নেই। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের আদালতের কাছে হস্তান্তর করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বাহিনী কর্তৃপক্ষের। এই আইনে যে কারও বিচার করা যাবে।’

এর আগে বিচারিক আদালতে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যের বিচারকার্য পরিচালিত হওয়া কয়েকটি মামলায় আসামিপক্ষের হয়ে লড়েছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আমিনুল ইসলাম।

কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের বিচারিক আদালতে বিচারের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ট্রাইবুনালের আইন ও অধ্যাদেশ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিচারে আইনগত কোনও বাধা নেই। তাদের যখন ট্রাইবুনালে সোপর্দ করা হবে তখন তাদের অব্যাহতি দিয়েই হস্তান্তর করার কথা। সেক্ষেত্রে তারা সাধারণ নাগরিকের মর্যাদাই পাবেন। বিশেষ হেফাজতে রাখারও কোনও প্রয়োজন নেই। তারা সাধারণ বন্দিদের মতোই জেল হেফাজতে থাকবেন। কারা বিশেষ সুবিধা পাবেন সেটা জেল কোডেই বলা হয়েছে। অতীতেও প্রচলিত বিচারিক আদালতে সেনা কর্মকর্তাদের বিচার হয়েছে।’

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন