নিউজ ডেস্ক:
হিজাব পরে আসায় ২২ ছাত্রীকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ফজিলাতুন নাহারকে। তবে শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগকে ‘মিথ্যা’ ও ‘সাজানো’ বলে দাবি করেন ওই প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) ভিকারুননিসার অ্যাডহক কমিটি শিক্ষক ফজিলাতুন নাহারকে সাময়িক বরখাস্ত করার পর বুধবার (২৭ আগস্ট) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ক্লাস বন্ধ করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখা ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করেন তারা।
অভিযোগ ও সাময়িক বরখাস্ত
হিজাব পরে আসায় শ্রেণি শিক্ষক ফজিলাতুন নাহার ষষ্ঠ শ্রেণির ২২ জন ছাত্রীকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। কয়েকটি গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাজেদা বেগমের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
সাময়িক বরখাস্তের চিঠিতে জানানো হয়, ‘ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা প্রভাতী শাখার ষষ্ঠ শ্রেণির ২২ জন শিক্ষার্থী হিজাব পরার কারণে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এবং অ্যাডহক কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বসুন্ধরা প্রভাতী শাখার সহকারী শিক্ষক ফজিলাতুন নাহারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।’
একইসঙ্গে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে কেন চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হবে না, এ মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
কী ঘটেছিল সেদিন
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রবিবার (২৪ আগস্ট) ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কয়েকজন ছাত্রী ড্রেসকোড না মেনে স্কুলে আসেন। প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী ঘটনার দিন ষষ্ঠ শ্রেণির ‘গ’ শাখার ছাত্রীদের ড্রেস কোড যাচাই করতে যান ভলান্টিয়ার-শিক্ষার্থীরা। শ্রেণিশিক্ষক ফজিলাতুন নাহার নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট পরে ক্লাসে প্রবেশ করেন। তখনও ভলান্টিয়ার ছাত্রীদের ড্রেস কোড চেক করছিলেন। শ্রেণিশিক্ষক যাদের ড্রেস কোড ঠিক আছে তাদের ক্লাসে রেখে অন্যদের বাইরে গিয়ে ড্রেসকোড ঠিক করে দ্রুত ক্লাসে ফিরতে বলেন। কিন্তু ছাত্রীদের দেরি দেখে শ্রেণিশিক্ষক ক্লাসের বাইরে যান। একজন শিক্ষার্থী হিজাব পরার নিয়ম জানতে চান। পরের দিন শিখিয়ে দেওয়া হবে বলেও শিক্ষক ওই ছাত্রীকে জানান।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ফজিলাতুন নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি কয়েক মিনিট দেরিতে ক্লাসে গিয়ে দেখি—ভলান্টিয়াররা ড্রেস কোড চেক করছিল। এছাড়া বাচ্চাদের পোশাক ঠিক আছে কিনা, নখ বড় কিনা, চুল বাঁধা ঠিক আছে কিনা তা দেখছিল। আমি ওদের (ভলান্টিয়ার) বললাম, তোমরা সারা দিন কী করলা? তারা বলে, আপা আমরা সময় পাইনি। তখন বললাম, তোমরা তাদের বাইরে নিয়ে যাও। বাইরে নিয়ে তোমাদের দায়িত্ব পালন করো। এটাই বলছি, মেয়েদের বের করে দেইনি।’
তিনি জানান, এই ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে ‘হিজাব পরায় ২২ ছাত্রীকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়ার’ মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে।
কিন্তু এই অভিযোগ ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে পত্রিকায় বিবৃতি দেয় দুয়েকটি সংগঠন। এরপর মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডি (অ্যাডহক কমিটি) তদন্ত না করেই সরাসরি সাময়িক বরখাস্ত করেন শিক্ষক ফজিলাতুন নাহারকে। ওই বিবৃতিটিও সোমবার (২৫ আগস্ট) গণমাধ্যমে ছাপাও হয়।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
হিজাব পরায় ছাত্রীদের ক্লাস থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া শিক্ষক ফজিলাতুন নাহার বলেন, ‘আমি এই কাজটা করিনি। আর এই ক্লাসে ২২ জন মেয়ে হিজাব পরে না। ৯ জন বা ১১ জন পরে। আমি মেয়েদের বলেছি তোমরা হিজাব পরে স্কুলে আসবা।’
শিক্ষক ফজিলাতুন নাহারকে যে অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে, সেই অভিযোগ সঠিক কিনা, জানতে চাইলে ভিকারুনসিনা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্ত করেছি। আমরা তদন্ত করে রিপোর্টর ওপর ভিত্তি করে আবার একটা সমাধান করবো।’
অধ্যক্ষ হিসেবে আপনি সাময়িক বরখাস্ত করেছেন নাকি গভর্নিং বডি করেছে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম বলেন, ‘অ্যাডহক কমিটি করেছে।’
অ্যাডহক কমিটি কোনও শিক্ষককে বরখাস্ত করতে পারে কিনা জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম বলেন, ‘আমরা তো বরখাস্ত করিনি। এটা সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমরা এটি দেখবো তদন্ত করে।’
প্রতিষ্ঠানের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ওই শিক্ষককে ফাঁসাতে মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। হিজাব কীভাবে পরতে হবে তার নিয়মও ছাত্রীদের উদ্দেশে বলেছিলেন বলে দাবি করেন এই শিক্ষক।
তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত না করেই তা সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটির অ্যাডহক কমিটি। নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন শিক্ষক জানান, অ্যাডহক কমিটির শুধুমাত্র রুটিন দায়িত্ব পালন করার কথা। কোনও শিক্ষককে বরখাস্ত করার ক্ষমতা তাদের নেই।
এদিকে ‘মিথ্যা’ অভিযোগে একজন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করায় অভিভাবক ঐক্য ফোরাম প্রশ্ন তুলেছে, বিবৃতি দিয়েছে। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বিবৃতিতে বলেন, ‘অ্যাডহক কমিটি কাউকে নিয়োগ দেওয়া বা কোনও শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করতে পারেন না।’
অ্যাডহক কমিটির এখতিয়ার প্রসঙ্গে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘অ্যাডহক কমিটি নিয়োগ দিতে পারে না, কাউকে চাকরিচ্যুতও করতে পারে না। চাকরি যাওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকলেও অ্যাডহক কমিটি চাকরি খেতে পারবে না।’
বিবৃতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকে আইনগত ব্যাখ্যা দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
সাবেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বক্তব্য
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হাসিনা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হিজাব পরা সংক্রান্ত ঘটনায় যে শিক্ষককে নিয়ে এত তোলপাড়— তিনি ভিকারুননিসারই ছাত্রী ছিলেন। ফজিলাতুন নাহার খুব ভদ্র ও ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। এমন ঘটনা তিনি ঘটাতে পারেন বলে বিশ্বাস করার সুযোগ নেই। বিষয়টির দ্রুত সমাধান হওয়া প্রয়োজন।’
প্রতিষ্ঠানটির আরেকজন সাবেক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ফজিলাতুন নাহার আমার সরাসরি ছাত্রী ছিল। সে এমন ঘটনা ঘটাতে পারে না। অভ্যন্তরীণ সমস্যা রয়েছে। একজন শিক্ষককে হটিয়ে দিতে পারলে আরেকজনকে নিয়োগ দেওয়া যায়, এমন সুযোগ রয়েছে।’
আন্দোলনরত দশম শ্রেণির ছাত্রী মেহের আফরোজ কনক বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে। তিনি ছাত্রীদের ড্রেসকোড মানতে বলেছিলেন। তাই তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে।’
আন্দোলনরত নবম শ্রেণির ছাত্রী রোকাইয়া বিনতে মাজহার বলেন, ‘‘আমাদের আপা কাউকেই হিজাব পরতে নিষেধ করেননি, তিনি সঠিকভাবে হিজাব পরতে বলেছিলেন। প্যানেল শিক্ষার্থী যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিলেন, তারা শেষ পিরিয়ডে ওই ক্লাসে গেলে আপা তাদের বলেছিলেন বাইরে গিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে নিতে। প্যানেল ছাত্রীরা ড্রেসকোড না মানা ছাত্রীদের বাইরে নিয়ে ৮-১০ মিনিট কথা বলেন। মূলত ওই ১০ মিনিটেই আমাদের শিক্ষকের নামে পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। এটা ‘সাজানো’ ঘটনা। আমরা আপার পুনর্বহাল, অপপ্রচারকারীদের শাস্তি চাই।’’
ভিকারুননিসার সাবেক ছাত্রী আনিসা করিম বলেন, ‘আমি ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছি। শুধু নাহার আপা নয়, অন্য শিক্ষকরাও কখনও হিজাব পরা নিয়ে কখনও কোনও কথা বলেননি। আমার বিশ্বাস, আপার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো করা হচ্ছে সেগুলো ভিত্তিহীন। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই, যারা আপার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়ে তার মানহানি করার চেষ্টা করছেন, তদের বিচার চাই।’