অনলাইন ডেস্ক :
প্রতিবছর কয়েক লক্ষ্যাধিক মানুষ জড়ো হয় দক্ষিণ ভারতের দুইটি বিশেষ মন্দিরে। অধিকাংশ মানুষই তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হবার বাসনা নিয়ে হাজির হন ওই মন্দির দুটোতে। বলা হয়, দক্ষিণ ভারতের এই মন্দির দুটির দেবতা খুবই জাগ্রত এবং তাদের কাছে শুদ্ধ মনে ইচ্ছা প্রকাশ করলে তা পূরণ হয়। কিন্তু মনোবাঞ্ছা পূরণে দিতে হয় কোনো কিছুর বিসর্জন বা বলিদান। তীর্থ ভ্রমনকারীদের মধ্যে এই বলিদান করার ক্ষেত্রে নিজেদের মাথার মুন্ডিত করা বা চুল ফেলে দেয়ায় প্রবনতা বেশি দেখা যায়। যুগ যুগ ধরে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরে এই রীতি প্রচলিত হয়ে আসছে।
গোপালা আম্মা তার পরিবারের মন্দভাগ্য দূর করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চেন্নাইয়ের শহরতলী নিকটবর্তী একটি এককক্ষ বিশিষ্ট ঘরে তাদের বসবাস। সম্প্রতি সেই ঘরটিও তাদের ছেড়ে দিতে হতে পারে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হলে গোপালা আম্মা এই মন্দিরে এসেছেন কোনো কিছু বিসর্জন দিয়ে হলেও নিজেদের থাকার স্থানটি রক্ষা করার জন্য। এই বিসর্জন দিতে হিয়ে গোপালা আম্মাকে কামাতে হচ্ছে তার প্রায় ৩২ ইঞ্চি লম্বা চুল। প্রাচ্যের নারীদের সৌন্দর্য্যের অন্যতম দিক হলো তাদের লম্বা চুল। আর সেই চুলকেই বিসর্জন দেয়া খুব একটা সহজ কথা নয়।
আম্মা একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং একটু ভালো থাকার জন্য প্রতিদিন তাকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়। কিছুদিন আগেই তার স্বামী চাকুরি হারায় এবং ওই ঘটনার পর থেকেই তিনি প্রচুর পরিমানে মদ খেতে শুরু করেন। এমনকি তাদের বড় সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থাও সৃষ্টি হয়েছে। আর এসব দিক বিবেচনা করে আম্মা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেবতার উদ্দেশ্যে কিছু বলি দিয়ে তার মন্দভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানোর। ‘আমি তিরুতান্নির মন্দিরে গিয়ে মাথার চুল কামিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর এর ফলে ঈশ্বর আমাকে এবং আমার পরিবারকে আশীর্বাদ করবেন।’-জানান গোপালা আম্মা।
ভারতে মানুষের মাথার চুল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ভারতীয় নারী আছেন যারা তাদের চিরুনি থেকে চুল সংগ্রহ করেন এবং মাসের একটি সময় সেই জমাকৃত চুল বিক্রি করে দেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে এই চুল কেনার জন্যও অনেক মানুষ আছেন। অনেক স্থানে গৃহস্থ নারীরা চুলের বিনিময়ে বিভিন্ন দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে অথবা কেউ কেউ নগদ অর্থও গ্রহন করেন। চিরুনিতে জড়িয়ে থাকা চুলের দাম তুলনামূলক বিচারে অনেকটা কম। কিন্তু একদম গোড়া থেকে কেটে ফেলা বড় চুলের অনেক দাম। কারণ বড় চুল হলে একজনের মাথার চুল দিয়েই একটি দামি পরচুলা তৈরি করা যায়। বাজারে এই পরচুলার অনেক দাম এবং সহজে পাওয়াও যায় না।
হলিউড, যুক্তরাজ্য থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত মানুষ যে নকল পরচুলা ব্যবহার করে তার অধিকাংশই আসে ভারত থেকে। প্রতিবছর ভারত এই চুল বিক্রি করে প্রায় আড়াইশ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করে। এক কিলোগ্রাম ওজনের কামাই করা চুল বিক্রি হয় কমপক্ষে ১৩০ থেকে ১৫০ ডলারে। গোপাল আম্মার মাথার চুল কামাইয়ের পর দেখা যায় তার চুলের ওজন ১৬০ গ্রাম। সেহিসেবে তার চুলের দাম হয় প্রায় বিশ ডলার। যদিও গোপালা আম্মার কাছে চুল বিক্রি করে বিশ ডলার উপার্জন করা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এই চুল ফেলে দেয়া বা কামানো নিয়ে বেশকিছু মিথ আছে। বলা হয়, ভগবান বিষ্ণুর মাথায় একবার কুঠারের আঘাত লাগায় তিনি কিছ চুল হারান। তখন নীলা দেবী নিজে উদ্যোগী হয়ে ভগবান বিষ্ণুকে এক গোছা চুল দান করেন। সেই থেকে যদি কেউ নিজের চুলের বিনিময়ে ভগবান বিষ্ণুর কাছে কিছু চান, বলা হয় সেই চাওয়া পূরণ হয়। একারণেই প্রতিবছর দক্ষিণ ভারতের তিরুতান্নি এবং তিরুপাতি মন্দির দুটো থেকে টনকে টন মানুষের চুল সংগ্রহ করেন চুল সংগ্রাহকরা।
মন্দির চত্বরের পাশেই আছে ‘কল্যাণকাত্তান’ বা ‘সুখের স্থান’ নামে একটি স্থান আছে। সেখানে শতাধিক নাপিত বসে থাকেন পূণ্যার্থীদের মাথার চুল কামানোর জন্য। পূণ্যার্থীরা নির্দিষ্ট পরিমান অর্থের বিনিময়ে এই নাপিতদের কাছে চুল কাটান। প্রতিজনের জন্য নাপিতরা ভারতীয় টাকার হিসেবে ১৫ রুপি নেন। তবে একটা সময় ছিল যখন মন্দিরে চুল কামানোর জন্য কোনো অর্থ দিতে হতো না। কিন্তু বর্তমানে আর সেই সুবিধা নেই। ধারনা করা হয়, প্রতিদিন তিরুপাতি মন্দিরে এক লাখেরও বেশি পূণ্যার্থী আসেন এবং বছরে এই পূণ্যার্থীদের মাথার কামানো চুল থেকেই মন্দিরটির আয় আছে প্রায় তিন মিলিয়ন ডলার। এই অর্থ মন্দিরের স্কুল এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়।