রাজনীতি ডেস্ক:
রাজনৈতিক দলের টিকে থাকার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে নির্বাচন। নিজেকে তুলে ধরতে হলে একটি গণতান্ত্রিক দলের নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিকল্প নেই। নির্বাচন থেকে দূরে থাকার মানেই হলো দলের অস্তিত্বকে সংকটে ফেলা। সেই হিসাবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে বিএনপি। নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ফুরিয়ে আসছে।
আবার দলটির প্রভাবশালী নেতারা বের হয়ে গিয়ে ভিন্ন নামে রাজনৈতিক দল খুলে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। দলত্যাগ করা থেকে তারা নেতাকর্মীদের বিরত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। সবমিলিয়ে আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য শাঁখের করাত। আবার আন্দোলন করেও গতি পাচ্ছে না দলটি। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, নেতাকর্মীদের কাছ থেকেও কোনো সাড়া মিলছে না।
নির্বাচন ঠেকাতে হরতাল কিংবা অবরোধের নামে জ্বালাও-পোড়াও করে জনগণের কাছ থেকে সহানুভূতি হারিয়েছে দলটি। কর্মসূচির নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকাই বিএনপির জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে আগামী ১৫ বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না বিএনপি। কঠিন সময়েও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কর্তব্য বলে মনে করেন তারা।
আরও ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকবে বিএনপি!
আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিলে পরবর্তী ১৫ বছরে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে মনে করেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। তিনি বলেন, ‘এখন যে উদ্ভূত পরিস্থিতি, তাতে বিএনপির জন্য নির্বাচনে আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এখন তারা যদি গোঁ ধরে, আর নির্বাচনে না আসে; তাহলে গেলো ১৫ বছর ধরে তারা ক্ষমতার বাইরে আছে, আরও ১৫ বছর তাদের ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে। অর্থাৎ পরিস্থিতি কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।’
নির্বাচনের জন্য বিএনপির প্রস্তুতি আছে জানিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, আগামী নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্তুতি যে নেই, তা কিন্তু না। আর তারা কী জানে না, সংবিধান অনুসারে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। তারা যখন আন্দোলন করছেন, তখন সেটাও তাদের জানা আছে। একটি দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কর্তব্য হলো- একদফার আন্দোলনে গিয়ে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় দফায় যাওয়া। অর্থাৎ নির্বাচনে অংশ নেয়া। যেটা আমি সবসময় বলে আসছি।
তিনি বলেন, বিএনপির এখনও উচিত হবে নির্বাচনে যাওয়া। মান-অভিমান, ক্রোধ, প্রতিহিংসা- এগুলো সবসময় রাজনীতিতে কাজ করে না। রাজনীতির প্রধান বিষয় হওয়া উচিত- বাস্তব পরিস্থিতি কী এবং বাস্তব পরিস্থিতিতে কী করা উচিত। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে মনে করেন এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। অর্থাৎ দলটির উচিত আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া।
দলটির অন্তরে আরেক দফা
বিএনপির একদফার আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে মাটিতে মিশে গেছে। তবুও কেন হরতাল ও অবরোধের নামে নাশকতার কর্মসূচি দিচ্ছে দলটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বলেন, বিএনপি যে প্রকাশ্যে একদফার আন্দোলন করেছে, তা সবাই জানেন। কিন্তু অন্তরে হয়তো অন্য কোনো দফা আছে। যেটা তারা বলতে পারছেন না। তাহলে কী সেই দফা বাস্তবায়ন হবে না বলেই তারা নির্বাচনে আসবে না?
বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের ঘোষিত একদফা বাস্তবায়িত যেমন হয়নি, তেমনই ভবিষ্যতেও হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, কাজেই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল হলে বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। তফসিল পুনর্নির্ধারণ করা হলেও তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। কারণ সারা দেশে তাদের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে।
বিএনপি নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার ঘোষণা দিয়েছে দলটির অনেক নেতাকর্মী বলে জানান তিনি। এই অধ্যাপক বলেন, যারা নির্বাচন চায়, যারা এই ধরনের গোয়ার্তুমি, দায়িত্বজ্ঞানহীন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পছন্দ করেন না; বিএনপির মধ্যে এমন লোকজনও আছে। বিএনপিতে এমন লোকও আছে; যারা সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যেমন, সমশের মবিন চৌধুরী একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তারা তো বিএনপির এসব গোয়ার্তুমি মেনে নিতে পারেন না।
একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে তাদের একটি স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নপূরণ নাহলে যদি সন্ত্রাস, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়, আর সেটাকে যদি রাজনীতি বলা হয়, তা তো তারা মানবেন না। আর এভাবে তো রাজনীতি হয় না, এটা পুরোপুরি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দল কখনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করবে না, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেবে তারা। তারা কখনও মানুষের জানমাল কেড়ে নেবে না। কাজেই বিএনপিতে যারা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি আছেন, তারা যদি বিদ্রোহ করেন, সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা। এমনটি হতে পারে।
রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যেই সমস্যা
বিএনপি যে রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে, তাতে সমস্যা আছে বলে মনে করেন অধ্যাপক হারুন। তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি থাকলেও তাদের নেতৃত্বের কোনো দায়িত্বশীল আচরণ নেই। তাদের রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে সমস্যা। বিএনপির আদর্শ বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না, বরং এরসঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তিনি বলেন, তারা শান্তি ও গণতন্ত্রের পক্ষের না, প্রকৃতপক্ষে তারা উন্নয়নের পক্ষে না। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।
বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীন নির্বাচন করতে চাচ্ছে, তারা নিজেরাই সেটার সর্বনাশ করেছে বলে মনে করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। তাহলে তাদের নিজেদের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। যে ইমামের পেছনে মানুষ নামাজ পড়বেন, তার যদি চরিত্র ঠিক না থাকে, তাহলে মুসল্লিরা তার পেছনে নামাজ আদায় করবেন না। বিএনপির সমস্যা হচ্ছে সেখানেই।’
জন্ম ও ক্ষমতায় আরোহণ অস্বাভাবিকভাবে
প্রথাগত রাজনৈতিক দলের যে ধারণা, জন্ম থেকেই কখনও সে রকম দল বিএনপি ছিল না বলে দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, বিএনপি নামের দলটির জন্ম ও ক্ষমতায় আরোহন অস্বাভাবিকভাবে। এমনকি তারা এতদিন টিকে আছে, সেটাও অস্বাভাবিক পন্থায়। কখনোই ক্ষমতায় যেতে পারবে না এমন অনেক দল বাংলাদেশে আছে, কিন্তু তাদের একটি দর্শন আছে। তাদের একটা কাঠামো আছে, বেড়ে ওঠার একটা ব্যবস্থা আছে।
এই শিক্ষাবিদ বলেন, বিএনপির সে রকম কোনো ঐতিহ্য কিংবা ইতিহাস নেই। অতীতও আছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির জন্ম ক্ষমতায় থেকে অস্বাভাবিকভাবে। এখন শত চেষ্টা করেও বিএনপিকে ঠিক করা যাবে না।
খুব খারাপ সময় অর্থাৎ যখন বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া নিষিদ্ধ, তখনও নির্বাচনে গেছে আওয়ামী লীগ। পেছনের দরজা দিয়ে আওয়ামী লীগ কখনোও ক্ষমতায় যায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। আব্দুল মান্নান বলেন, গেলো ৭৫ বছরের ইতিহাসে সবসময়ই একটা ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। খুব খারাপ সময়েও তারা টিকে ছিল।
বিএনপি যদি সংগঠনে বিশ্বাস করে, তাহলে দলটির নির্বাচন আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।