জাতীয় ডেস্ক:
হাতেগোনা আর কটা দিন। তারপরই শুরু হতে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব। এ বৈসাবি উৎসবের আমেজে ভাসছে খাগড়াছড়ি শহর। শহরতলী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত পাহাড়ি পল্লীতেও চলছে আনন্দ উল্লাস। আর এ উৎসবকে ঘিরে উৎসবের নগরে পরিণত হয়েছে পার্বত্য জনপদ খাগড়াছড়ি। ইতিমধ্যে পাড়া মহল্লায় বৈসাবি ঘিরে চলছে প্রস্তুতি।
চলছে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা,গান বাজনা আনন্দ উল্লাস ও কেনা করাটা। ইতিমধ্যে বৈসু, সাংগ্রাই ও বিজু উৎসব উপলক্ষে খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত পল্লী থেকে শহর ও শহরতলীতে শুরু হয়েছে বিজু মেলা, সাংস্কুতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলা।
যেন বৈশাখের রঙে ও বৈসাবির সাজে সেজেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। আর পাহাড়ের প্রাণের উৎসব যেন বৈসাবি। পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত তিনটি জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব চাকমাদের বিজু, মারমাদের সাংগ্রাই ও ত্রিপুরাদের বৈসু’র আদিক্ষ্যরে মিলিত ‘বৈসাবি’ কে ঘিরে পাহাড়ি পল্লীগুলো সেজেছে যেন বৈসাবি সাজে। পাহাড়ি মেয়েরা বৈসাবিতে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে যেন আকুল মনে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। আজ ৫ এপ্রিল থেকে খাগড়াছড়িতে শুরু হচ্ছে বৈসাবি উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
বৈসাবি বাংলাদেশের তিন পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব। বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু এই তিন নামে আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় তারা। পাহাড়িরা বর্ষবরণ উৎসব পালন করে বিভিন্ন নামে। কেউ বৈসু, কেউ সাংগ্রাই আবার কেউ বিজু। বর্ষবরণ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে অভিহিত করে এবং এগুলি বৈসাবি নামে পরিচিত। সাধারণত বছরের শেষ দুইদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি পালিত হয় খাগড়াছড়ি, রাংগামাটি ও বান্দরবান, পার্বত্য জেলায়।
চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসব হলো বিজু। এরা তিন ভাগে ভাগ করে বিজু উৎসব পালন করে। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ফুল বিজু, ৩০ তারিখে মূল বিজু এবং বৈশাখের প্রথম দিনে গজ্যাপজ্যা বিজু নামে অনুষ্ঠান পালন করে। ফুল বিজুর দিন গভীর অরণ্য থেকে ফুল সংগ্রহ করে চারভাগে ভাগ করে একভাগ ফুল ও নিমপাতায় ঘরবাড়ি ঘর সাজায়, দ্বিতীয় ভাগ ফুল বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে প্রার্থনা করে ও ভিক্ষুসংঘের প্রদত্ত ধর্মোপদেশ শ্রবণ করে, তৃতীয় ভাগ ফুল নদী, খাল বা পুকুরের পাড়ে তৈরি পূজামণ্ডপে রেখে প্রার্থনা করে এবং চতুর্থভাগ ফুল প্রিয়জনকে উপহার দেয় এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়।
মূল বিজুর দিনে অসংখ্য কাঁচা তরকারি সংমিশ্রণে পাচন বা ঘণ্টা তৈরি করা হয়। এছাড়া পায়েস ও নানা ধরনের পিঠা তৈরি করা হয় এবং মাছ-মাংস রান্না করা হয়। বিন্নি ধানের খই, নাডু, সেমাই ও পাহাড়ি মদও থাকে। এই দিনে চাকমারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে র্যালিতে যোগ দেয়, অবালবৃদ্ধবনিতা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং শিশুকিশোর তরুন তরুণীরা খেলাধুলায় মেতে উঠে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘর, উঠান ও গোশালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়। মন্দিরে গিয়ে মোম জ্বালিয়ে ফুল দিয়ে বুদ্ধের পূজা করা হয়।
গজ্যাপজ্যা অনুষ্ঠিত হয় নববর্র্ষের প্রথম দিনে। এদিন চাকমারা বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে বিশ্রাম করে। তারা বড়দের স্নান করিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। সন্ধ্যায় সবাই বৌদ্ধবিহারে গিয়ে ধর্ম অনুশীলনে রত হয়, ভিক্ষু সংঘের ধর্মোপদেশ শুনে এবং বিশেষভাবে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে।
মারমারা পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবকে সাংগ্রাই উৎসব বলে। তারা বৈশাখের প্রথম দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পাচন, পিঠা এবং নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা জনগোষ্ঠী। সবাই নতুন পোশাক পরে, একে অপরের বাড়ি যায় এবং কুশল বিনিময় করে। সব বয়সের নারীপুরুষ সম্মিলিতভাবে নাচ আর গানে মেতে ওঠে। মারমা বৃদ্ধরা অষ্টশীল পালনের জন্য মন্দিরে যায়।
এদিন বুদ্ধ মূর্তিকে চন্দন জলে স্নান করানোর পর বৃদ্ধবৃদ্ধারাও স্নান করে এবং নতুন পোশাক পরিধান করে। বয়স্করা মন্দিরে ধর্ম অনুশীলনে রত হয়। মারমা জনগোষ্ঠীর এ দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে জল অনুষ্ঠান বা পানি খেলা। মারমা ভাষায় জল অনুষ্ঠানকে বলা হয় রিলংপোয়ে। বাড়ির আঙিনায় আগে থেকে পানি খেলার জন্য প্যান্ডেল তৈরি করা থাকে। মারমা যুবকরা বাদ্য আর গানের তালে তালে এসে উপস্থিত হয় অনুষ্ঠানস্থলে। সেখানে ফুলে ফুলে সজ্জিত প্যান্ডেলের ভিতরে পানি নিয়ে অপেক্ষায় থাকে মারমা তরুণীরা। চলে যুবকযুবতীদের এক অপরের প্রতি জল ছিটানো। পানিকে পবিত্রতার প্রতীক ধরে নিয়ে মারমা তরুণতরুণীরা পানি ছিটিয়ে নিজেদের শুদ্ধ করে নেয়।
ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বৈসু। বৈসু উৎসব এদের জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব। বৈসু উৎসব একটানা তিন দিন পালন করা হয়। এই তিন দিনের অনুষ্ঠানগুলির নাম হলো হারি বৈসু, বিসুমা বৈসু ও বিসিকাতাল বা আতাদাং বৈসু। বৈসু উৎসবের প্রথম দিন হারি বৈসু। এই দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারা ঘরদোর লেপেপোঁছে, বসতবাড়ি কাপড় চোপড় পরিস্কারপরিচ্ছন্ন করে। ত্রিপুরারা বিশেষ একপ্রকার গাছের পাতার রস আর হলুদের রস মিশিয়ে গোসল করে। ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায়। গবাদিপশুদের গোসল করানো হয় এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয়। শিশুরা বাড়ি বাড়ি ফুল বিতরণ করে। তরুণ তরুণীরা প্রিয়জনকে ফুল উপহার দেয়। দেবতার নামে নদীতে বা ঝর্ণায় ফুল ছিটিয়ে খুমকামীং পূজা দেওয়া হয়। কেউ কেউ পুষ্পপূজা করে।
এদিন মহিলারা বিন্নি চাউলের পিঠা ও চোলাই মদ তৈরি করে। পুরুষেরা বাঁশ ও বেত শিল্পের প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলায় মেতে ওঠে। এদিন এরা দাং, গুদু, চুর, সুকুই, উদেং ও ওয়াকারাই খেলায় অংশগ্রহণ করে। জুম কৃষক পাড়ার মধ্যে হাঁসমুরগির জন্য শস্যদানা ছিটিয়ে দেয়। হারি বৈসু উৎসবের দিন থেকে এরা গরাইয়া নৃত্য পরিবেশন শুরু করে। এ নৃত্য সাত দিন থেকে আটাশ দিন পর্যন্ত চলে। ঢোলের তালে তালে সারিবদ্ধভাবে লোকজন নাচে। নাচ শেষে গরয়া পূজার ব্যবস্থা করা হয়।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন বিসুমাতে ত্রিপুরারা নববর্ষকে স্বাগত জানায়, ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে পূজা দেয় ও উপাসনা করে। সবাই গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুর বেড়ায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাচন, সেমাই ও মিষ্টি খায় এবং কলাপিঠা, চুয়ান পিঠা, জাল পিঠা, উন পিঠা ও মায়ুং পিঠা খায়। এছাড়া এদিন তারা নিরামিষ ভোজন করে। কোনো প্রাণি বধ করে না। অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন বিসিকাতালে আমিষ খাবার গ্রহণে বাধা নেই। এদিনও ফুল দেওয়া হয় ও উপাসনা করা হয়। তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের গোসল করিয়ে পায়ের কাছে পূজার নৈবেদ্য হিসেবে ফুল রাখে এবং প্রণাম করে। কেউ কিছু না খেয়ে ফিরে না যায় সেজন্য সারাদিন ঘরের দরজা খোলা থাকে। এতে গৃহস্থের কল্যাণ হবে বলে মনে করা হয়।
বৈসাবি মানেই রঙে বর্ণে বৈচিত্র্যময় এক ঐতিহ্যবাহী উৎসব। বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু, যে নামেই বলা হোক না কেনো, এ উৎসব যেনো পাহাড়িদের প্রেরণা-পাহাড়ের জাগরণ। মূলত তিন সম্প্রদায়ের বার্ষিক প্রধান উৎসবের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি নামের সৃষ্টি। বৈ-তে ত্রিপুরাদের বৈসু, সা-তে মারমাদের সাংগ্রাই আর বি-তে চাকমা সম্প্রদায়ের বিজুকে বোঝানো হয়েছে। এ বৈসাবিকে ঘিরে স্থানীয় হাটবাজারগুলোতে চলছে ধুম বেচাকেনা। সকাল থেকে শুরু করে রাত অবধি কাপড়ের দোকান, জুয়েলারি দোকানগুলোতে দেখা যাচ্ছে উপচে পড়া ভিড়। মনোহারি দোকানগুলোতেও চলছে ব্যাপক বেচাকেনা। এসব দোকানে পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালিরাও সমভাবে ভিড় করছে। বৈসাবিতে অংশ নিতে প্রতিনিয়ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান হতে আপন ঠিকানায় ছুটে আসছে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া পাহাড়ী শিক্ষার্থীরাও। যেন এ উৎসব অসম্প্রদায়িক উৎসব।
প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের পাশাপাশি পাহাড়ের বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ঐতিহ্যবাহী দিনটি পালন করে থাকে। এদিকে বৈসাবি উৎসব শুরু হতে আরো কয়েকদিন বাকী থাকলেও ইতিমধ্যে শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় চলছে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা। ঘরে ঘরে চলছে পুরাতন বছর বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগতম জানানোর প্রস্তুতি। এদিকে পাহাড়ে বাংলা নববর্ষ এবং বৈসাবি উদযাপন উপলক্ষে পার্বত্য জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকেও ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। তাছাড়া পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগেও ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে গ্রামীণ খেলাধুলা।
এ উৎসবকে ঘিরে খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইনস্টিটিউটের আয়োজনে আজ শুক্রবার (৫ এপ্রিল) থেকে শুরু হয়েছে ৫ দিনব্যাপী বৈসাবি মেলা। শান্তির পায়রা উড়িয়ে ও মারমাদের জলকেলি পানি ছড়িয়ে এ মেলার উদ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুই প্রু চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন , খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো. আমান হাসান,গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাইসুল ইসলাম,খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু, খাগড়াছড়ি ডিজিএফআই’র ডেট কমান্ডার কর্নেল আব্দুল্লাহ মো. আরীফ, খাগড়াছড়ি সদর জোন কমান্ডার লে. কর্নেল আবুল হাসনাত জুয়েল, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান, খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মুক্তা ধর ও খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী, জেলা পরিষদের সদস্যসহ বিভিন্ন দপ্তরের বিভাগীয় প্রধান ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা।
মেলায় চলছে পাহাড়ী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পাঁচন রান্না, বেইন বুনন, রচনা প্রতিযোগিতা সহ চাকমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ঘিলে খেলা, ত্রিপুরাদের সুখই খেলা ও মারমাদের ‘ধ’ খেলাসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা শুধুই মেলায় নয়, দুর্গম পাহাড়ি সব পল্লীতে যুবক-যুবতীরা এসব খেলায় মেতে রয়েছে।
বংশ পরম্পরায় পালিত এ উৎসবের সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া আর বাংলা’র মিশেলে বৈসাবি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন অন্য এক পাহাড়িয়া উৎসবে। উৎসবে সবার অংশগ্রহণে সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে; এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।