হোম রাজনীতি বিএনপির বড় নেতারা কারাগারে, কর্মীরা ঘরছাড়া

রাজনীতি ডেস্ক:

পুলিশের করা ১০টির মতো মামলায় চট্টগ্রাম বিএনপির কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে বেনামে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে আছেন জেলা, মহানগর থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও। তাঁদের ধরতে পুলিশ দফায় দফায় অভিযান চালাচ্ছে। এতে চট্টগ্রামে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে গ্রেপ্তার-আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এমন চিত্র সারা দেশেই।

দলীয় নেতা-কর্মীদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নান বলেন, ‘পুলিশের মিথ্যা মামলায় আমাদের সাধারণ কর্মীদের পর্যন্ত বাড়িতে থাকা হারাম হয়ে গেছে। পুলিশ প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি ও গ্রেপ্তার করছে। গ্রেপ্তার এড়াতে নেতা-কর্মীরা বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।’

সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচন-কালীন নির্দলীয় সরকারের এক দফা দাবিতে আন্দোলনের ‘চূড়ান্ত পর্যায়ে’ দেশজুড়ে ধরপাকড় আর মামলায় জেরবার হচ্ছে বিরোধী দল বিএনপি। শীর্ষপর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রতিদিনই আটক হচ্ছেন দলটির অনেক নেতা-কর্মী। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের দিন পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নয়াপল্টনসহ কয়েকটি এলাকা।

প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। ওই ঘটনার পর থেকে একে একে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কেন্দ্রীয় নেতাকে। দলের স্থায়ী কমিটির সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে অন্য চারজন গ্রেপ্তার-আতঙ্কে আত্মগোপনে আছেন। গতকাল সন্ধ্যায় আটক করা হয়েছে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্সকে। পরিবারের অভিযোগ, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বাড্ডায় তাঁর বোনের বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে নিয়ে গেছে।

পুলিশ ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, হরতাল ও তিন দিনের অবরোধ ঘিরে যশোরে গতকাল পর্যন্ত বিএনপির সাড়ে চার শর মতো নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় ২২টি মামলা দিয়ে আসামি করা হয়েছে দেড় হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে। খুলনায় নাশকতার নতুন মামলায় ১১ বছর আগে মৃত্যুবরণকারী এমনকি জেলখানায় বন্দী থাকা ব্যক্তিসহ বিএনপির নেতা-কর্মীদের আসামি করে বেশ কিছু মামলা করেছে পুলিশ। জেলার ৯ থানায় ১২টি এবং মহানগরীর তিনটি থানায় তিনটি মিলিয়ে মোট ১৫টি মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশে গিয়ে খুলনার ১২৭ জন নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হন।

বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, মামলা হলে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। যেহেতু মামলা হয়েছে, তাই গ্রেপ্তার এড়াতে অনেক নেতা-কর্মী নিরাপদ দূরত্বে আছেন। পুলিশি অভিযানের ভয়ে অনেকে বাড়িছাড়া।

এ অবস্থায় আগামী দিনে দলীয় কর্মসূচি পালন করা নিয়ে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করলেও আশার কথা বলছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও এক দফার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে বিএনপি। দেশব্যাপী এক দিন হরতাল ও তিন দিনের টানা অবরোধের পর আজ রোববার ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত আবারও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে দলটি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান গতকাল শনিবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মিথ্যা মামলা-হামলা আর ধরপাকড়ের মাধ্যমে জনগণের এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে না। যত দিন না এ দেশের মানুষের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হবে, তত দিন আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলতেই থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, গত কয়েক দিনে সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন, যাকেই যেখানে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠছে।

এদিকে বিরাজমান পরিস্থিতিতে কর্মীশূন্য হয়ে পড়েছে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়।দলের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানানোর দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি অজানা স্থান থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করে দলের সিদ্ধান্তের কথা জানাচ্ছেন। গতকাল বিকেলে এমনই এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সারা দেশে নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় ও মামলার চিত্র তুলে ধরেন রিজভী। তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭৬ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলায় ৫৭৫ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ২৩ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সময়ে মামলা হয়েছে ১১৩টি।

বিএনপির একাধিক সূত্রের দাবি, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে সারা দেশে গণহারে গ্রেপ্তার চলছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলা না থাকলেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরে পরে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও মৃত এবং কারাবন্দী ব্যক্তির নামেও মামলা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় দলীয় কার্যালয় বন্ধ রাখা হচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেক নেতা-কর্মী দূরবর্তী স্থানে আত্মীয় অথবা বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। পুলিশ নেতা-কর্মীদের ধরতে গিয়ে না পেলে তাঁদের স্বজনদের হুমকি দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আসামি না পেলে বৃদ্ধ বাবা, ভাই এমনকি শ্বশুরকেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

গ্রেপ্তার আর মামলার আতঙ্ক নিয়ে আগামী দিনের কর্মসূচি পালনে সংশয়ের কথাও জানিয়েছেন তৃণমূল বিএনপির কোনো কোনো নেতা-কর্মী। তাঁরা বলছেন, গণহারে গ্রেপ্তার ও মামলার ভয়ে কর্মীরা এখন দিশেহারা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশ এলেও স্থানীয় পর্যায়ে তা সমন্বয় করার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। সভা-সমাবেশে বক্তব্যে মুখর থাকেন যাঁরা, স্থানীয় পর্যায়ের সেই সংগঠকদের অনেকে সংকটকালে যে যার মতো নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মীরা ফোন দিলেও নেতারা ধরছেন না।

তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, গ্রেপ্তার-ধরপাকড় আর মামলা দিয়ে নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া করে যারা বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার কথা ভাবছে, তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের এভাবে ধরপাকড় নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের পথে অন্তরায় বলেও মনে করছেন কোনো কোনো রাজনীতি-বিশ্লেষক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. শামছুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ থাকবে না। উত্তর কোরিয়ার মতো নির্বাচন হতে পারে। সেটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।বর্তমান সংকট মোকাবিলায় সংলাপেরও কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না এই বিশ্লেষক।

চট্টগ্রাম ও কিশোরগঞ্জে আজ হরতাল পূর্বঘোষণা অনুযায়ী আজ রোববার ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত সারা দেশের সড়ক, নৌ ও রেলপথে সর্বাত্মক অবরোধ পালন করবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। ৪৮ ঘণ্টার এই অবরোধের মধ্যেই আজ চট্টগ্রাম ও কিশোরগঞ্জে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে স্থানীয় বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলমকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এই হরতাল ডাকা হয়েছে।

এদিকে ঢাকা মহানগর পরিবহন মালিক সমিতি জানিয়েছে, বিএনপির ডাকা অবরোধে রাজধানীতে গণপরিবহন চলবে। একই সঙ্গে ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল করবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল ঢাকা মহানগর সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক গোলাম সামদানী আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগের মতোই গাড়ি চলাচল করবে। অবরোধে কোনো গাড়ি বন্ধ থাকবে না।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. আনোয়ার হোসেন জানান, অবরোধে ট্রেনের কোনো সময়সূচি পরিবর্তন হবে না। ট্রেন সময়মতো চলবে।লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী জানান, লঞ্চ চলাচল যাত্রীর ওপর নির্ভর করবে। তবে বন্ধ থাকবে না।

[প্রতিবেদনের জন্য তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন যশোর, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ভৈরব থেকে আমাদের প্রতিবেদক, প্রতিনিধিরা।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন