অনলাইন ডেস্ক:
ঘর নেই। দুয়ার নেই। বসার জায়গা নেই। ঘুমানোর জায়গা নেই। খাওয়ার জায়গা নেই। রান্নার জায়গা নেই। মাথার ওপরে ছাদ নেই। মানুষ মারা গেলে কবর দেওয়ার জায়গাটুকুও নেই। এত নেই-এর ভিড়ে নিরুপায় দেশের বন্যাকবলিত ৩৩ জেলার ১৫৯টি উপজেলার ৫৪ লাখেরও বেশি মানুষ। তাদের জীবনযাপন এখন যাযাবরের মতো। একাধিক জেলার বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
কুড়িগ্রামের চিলমারির বাসিন্দা সোহরাব হোসেন বলেন, ‘বন্যার পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে শহর রক্ষা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। বৃষ্টি নামলে ভিজতে হয়। রোদেই আবার শুকাই। খাওয়ার নিশ্চয়তা নাই। ঘুমাবার নিশ্চয়তা নাই। এই পানি কবে কমবে আর কবে বাড়ি ফিরতে পারবো তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।’
জামালপুরের ইসলামপুরের বাসিন্দা তাজু মুনশির দাবি, যমুনার পানিতে প্রতিবছরই বাড়িঘর তলিয়ে যায়, এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। তার কথায়, ‘পানির সঙ্গে সংগ্রাম করে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। বাড়ির এক ইঞ্চি জমিও শুকনা নাই। সবই পানির তলে। গত ৩০ জুলাই আমার একজন আত্মীয় মারা গেছেন। তাকে বাড়ির কবরস্থানে দাফন করতে পারিনি। কারণ কবরস্থান পানিতে ডুবে আছে। এ কারণে উপজেলা কবরস্থানে দাফন করতে হয়েছে।’
পাবনার চাটমোহরের বাসিন্দা মোহম্মদ শাহীন মিয়া জানিয়েছেন, পদ্মার পানি বাড়তে শুরু করায় এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। তিনি গরু-বাছুর সরিয়ে নিয়েছেন আত্মীয়ের বাড়িতে। তার আশঙ্কা, পানি আরও বাড়লে বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু আশ্রয়ের দিকে ছুটতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা ও বন্যার কারণে প্রতিদিনই মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। নিরুপায় হয়ে পড়া বানভাসিদের দুরবস্থা দেখতে বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি এলাকায় যান না। বন্যা ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মনে এবারের ঈদের আনন্দ ছিল না।
বন্যাকবলিত এলাকাবাসী জানিয়েছে, এবারের বন্যায় আউশ ধান, আমনের বীজতলা ও সবজি ক্ষেত জলে ভেসে গেছে। অনেকের বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেছে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত দেশের ৩১টি জেলা বন্যাকবলিত ছিল। একদিনের ব্যবধানে এই তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে গোপালগঞ্জ ও পাবনা জেলা। বর্তমানে দেশে বন্যাকবলিত জেলার সংখ্যা ৩৩টি। এগুলো হলো– লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, নওগাঁ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, নাটোর, গাজীপুর, রাজশাহী, মৌলভীবাজার, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, গোপালগঞ্জ ও পাবনা।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, গোপালগঞ্জে মধুমতি নদী ও কুমার নদের পানি বাড়তে থাকায় জেলা সদর, কাশিয়ানী ও মুকসুদপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বসতবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে, তলিয়ে গেছে সড়ক। এতে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয়রা। অনেকে পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশুসহ স্থানীয় স্কুল ও সড়কের পাশের উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের (এনডিআরসিসি) দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত দেশের ৩৩ জেলায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৪০ হাজার ৩৩১ জন। এ পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ১ হাজার ৫৩৩টি। এগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন ৬৩ হাজার ৪০৯ জন। এছাড়া আছে ৭৮ হাজার ৪৬টি গবাদি পশু। বন্যার পানিতে ডুবে ও নৌকা ডুবে আর বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছেন ৪৩ জন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে বানভাসিদের জন্য ১৪ হাজার ৪১০ মেট্রিক টন জিআর চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা নগদ, ৩০০ বান্ডেল ঢেউটিন, গোখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা এবং শিশুখাদ্য কিনতে বরাদ্দ রয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আশা করছে– মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শরীয়তপুর ও ঢাকা জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এছাড়া কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকা সিটি করপোরেশন সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানি স্টেশনের মধ্যে ৩৪টির পানি বাড়ছে, ৬৬টির কমছে ও অপরিবর্তিত রয়েছে একটির।