নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় শুক্রবার (১ আগস্ট) ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
শুল্ক নিয়ে হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় এই পরিমাণের কথা উল্লেখ করা হয়।
হোয়াইট হাউসের ঘোষণা অনুযায়ী, অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ, ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ, ফিলিপাইনের ওপর ১৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ওপর ২০ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ওয়াশিংটন।
ভারতের তুলনায় কম শুল্ক বড় সুযোগ
বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেলবাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই সিদ্ধান্ত অনেকাংশেই বাংলাদেশের জন্য খুশির খবর। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বাজার হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় প্রথমে ভারতকে সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আমাদের চেয়ে ভারতের ওপর বেশি শুল্ক নির্ধারণ হয়েছে—২৫ শতাংশ। এর মানে, মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশকেই চীনের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন।
তিনি বলেন, আমরা যদি দ্রুত উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারি, উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি এবং সময়মতো পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের রপ্তানি অনেক বাড়বে।
পাল্টা শুল্ক হ্রাস করে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ এখন পাকিস্তান, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বিশেষ করে ভারত ও চীনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম শুল্ক হার আমাদের সুযোগ বাড়াতে সহায়ক হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের বাজার থেকে সরে আসা ব্যবসাগুলোর একটি অংশ এখন বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকতে পারে। যদিও স্বল্পমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের খুচরা দামে কিছুটা বৃদ্ধি হতে পারে এবং বিক্রিতে সাময়িক প্রভাব পড়তে পারে, তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলছে—বাংলাদেশ এ ধরনের বৈশ্বিক চাপে আগেও সফলভাবে টিকে থেকেছে।
মহিউদ্দিন রুবেল বলেন , শুল্ক কমানোর ফলে আমরা এখন আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে আছি। এটা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের পক্ষে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং নতুন বাণিজ্য বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারলেই দেশের প্রবৃদ্ধি আরও সুসংহত হবে।
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, নীতি সহায়তা এবং সরকারি কৌশলগত প্রস্তুতির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তার মতে, এগুলো নিশ্চিত করা গেলে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
আলোচনার পেছনের কূটনৈতিক তৎপরতা
বাংলাদেশের পক্ষে শুল্ক আলোচনায় নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ওয়াশিংটন ডিসিতে ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিসে চূড়ান্ত দফার আলোচনায় অংশ নেয়া হয়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ।
আলোচনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি ‘ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করেছে, যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষিপণ্য, প্রযুক্তিপণ্য ও কিছু সামরিক সরঞ্জাম আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
নতুন করে রফতানির গতি ফিরবে?
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই শুল্ক ছাড় একদিকে যেমন পোশাক শিল্পকে স্বস্তি দিচ্ছে, অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকার পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ, তবে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে হলে কস্ট অব ডুইং বিজনেস কমাতে হবে। ব্যাংকিং সহায়তা, কাঁচামাল আমদানি ও দ্রুত শুল্ক ছাড়ের প্রক্রিয়াগুলো সহজ করা জরুরি।
শিল্প মালিকদের প্রত্যাশা ও সতর্কতা
দেশের তৈরি পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, এখন সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার। অনেক বিদেশি ক্রেতা শুল্ক জটিলতার কারণে অনিশ্চয়তায় ছিলেন, এখন আবার তারা বাংলাদেশমুখী হতে পারেন। তবে তা বাস্তবে রূপ দিতে হলে: প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা, সহজতর রপ্তানি ঋণ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ-জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ, সমুদ্র বন্দরে কার্যকর লজিস্টিক সহায়তা এগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থনীতিতে সম্ভাবনার আলো
বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বাজারে আবারও অবস্থান সুসংহত করার সুযোগ পেল বাংলাদেশ। এবার এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রপ্তানি খাতকে আরও শক্তিশালী ও টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের ওপর আজ থেকে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির অজুহাতে চলতি বছরের ২ এপ্রিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওই সময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও অন্যান্য পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। তবে পরে ৯ এপ্রিল তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয় এবং এই সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আলোচনার সুযোগ দেয় ওয়াশিংটন।
তিন মাসের সেই সময়সীমা শেষ হয় ৯ জুলাই। তার একদিন আগে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি চিঠি পাঠান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। চিঠিতে তিনি জানান, বাংলাদেশের ওপর আরোপিত পাল্টা শুল্ক হার ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে ৯ জুলাইয়ের পরও যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন শুল্ক কার্যকর করেনি। শুল্ক কাঠামো পুনর্বিবেচনায় ওয়াশিংটন ৩১ জুলাই পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সময় দেয়। সেই সময়সীমা শেষে আজ ১ আগস্ট থেকে নতুন পাল্টা শুল্ক কার্যকর হচ্ছে। ফলে আজ থেকে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রে গড় ১৫ শতাংশ আমদানি শুল্কের পাশাপাশি ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক, মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে।
এই শুল্ক পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছে। দেশটির বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতর ইউএসটিআরের সঙ্গে শুল্ক কমানোর লক্ষ্যে টানা তিন দিন ধরে বৈঠক করেছে প্রতিনিধি দল। মঙ্গলবার ও বুধবারের পর বৃহস্পতিবার ছিল আলোচনার তৃতীয় দিন।