বর্তমানে (৩০ জুলাই পর্যন্ত) দেশের বন্যাকবলিত ৩১ জেলার পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখ ৯৭ হাজার ৪২৪ জন। পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৪৪৭টি। বন্যাকবলিত পানিবন্দি এসব মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ সহায়তা বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৩ হাজার ১০ মেট্রিক টন জিআর চাল। নগদ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। শিশুখাদ্য কেনার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮৪ লাখ টাকা। গবাদিপশুর খাদ্য কেনার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ১ লাখ ৪০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৩০০ বান্ডিল ঢেউটিন ও গৃহনির্মাণ খরচ বাবদ বরাদ্দ করা হয়েছে ৯ লাখ টাকা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, বন্যাকবলিত ৩১ জেলার পানিবন্দি মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত চাল, নগদ টাকা, শুকনো খাবার প্যাকেট, শিশুখাদ্য কেনা বাবদ নগদ অর্থ গবাদিপশুর খাবার কেনার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ও গৃহনির্মাণ বাবদ ঢেউটিন ও বরাদ্দ করা টাকা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসন এখন পর্যন্ত বরাদ্দকৃত ত্রাণ সহায়তা শতভাগ বিতরণ করতে পারেনি।
জানা গেছে, বরাদ্দ করা ১৩ হাজার ১০ টন জিআর চালের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৮ হাজার ৪৪২ মেট্রিক টন, মজুত আছে ৪ হাজার ৫৬৭ মেট্রিক টন। নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে ২ কোটি ১২ লাখ ৫৮ হাজার ৭০০ টাকা। মজুত রয়েছে ১ কোটি ২৩ লাখ ৯১ হাজার ৩০০ টাকা। শিশুখাদ্য কেনা বাবদ বরাদ্দকৃত ৮৪ লাখ টাকার মধ্যে এযাবৎ বিতরণ করা হয়েছে ৬০ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। শিশুখাদ্য কেনা বাবদ এখনও মজুত আছে ২৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। গোখাদ্য কেনার জন্য বরাদ্দকৃত ২ কোটি ১৮ লাখ টাকার মধ্যে খরচ করা গেছে ১ কোটি ৭ লাখ ৬ হাজার টাকা। এখনও জমা রয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। বরাদ্দ করা ৩০০ বান্ডিল ঢেউটিনের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ১০০ বান্ডিল, মজুত রয়েছে ২০০ বান্ডিল ঢেউটিন। গৃহনির্মাণ বাবদ বরাদ্দ করা ৯ লাখ টাকার মধ্যে এযাবৎ বিতরণ করা গেছে ৩ লাখ টাকা। এখনও জমা রয়েছে ৬ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, শুক্রবার ৩১ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ দেশের বন্যাকবলিত ৩১ জেলা হচ্ছে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, ফেনী, নওগাঁ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, নাটোর, গাজীপুর, মৌলভীবাজার, মুন্সীগঞ্জ ও চাঁদপুর। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এসব জেলার ১৫০টি উপজেলার ৯৪৭টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত মারা গেছে ৪১ জন। বন্যাকবলিত জেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ১ হাজার ৫৪৬টি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৩৯০ জন।
বন্যাকবলিত চার জেলায় কোনও আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়নি। জেলাগুলো হচ্ছে মৌলভীবাজার, নোয়াখালী, রংপুর ও লালমনিরহাট। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় নীলফামারী, সিলেট ও নওগাঁ জেলায় খোলা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন বাড়ি চলে গেছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে ৯৩টি, কিশোরগঞ্জে ৮৫টি, ঢাকায় ৪০টি, মানিকগঞ্জে ১৯৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এসব আশ্রয়কেন্দ্রে কোনও পানিবন্দি মানুষ আসেনি।
অপরদিকে বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করায় নেত্রকোনা ও নওগাঁ জেলায় খোলা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষজন বাড়ি চলে গেছে। নেত্রকোনা জেলায় বন্যাকবলিত উপজেলাগুলো হচ্ছে দূর্গাপুর, কলমাকান্দা, খালিয়্জুড়ি, বারহাট্টা ও মদন। এসব উপজেলার ৩১টি ইউনিয়নের ১২ হাজারের বেশি মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। তবে সেখানে পানি কমতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
বন্যাকবলিত জেলায় ৯৫৯টি মেডিকেল টিম গঠন করলেও ৩৮৭টি টিম কাজ করছে। এসব জেলার মাছের ঘেরের মাছ ভেসে গেছে, সবজি ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। তবে এর হিসাব এখনও করা সম্ভব হয়নি। বন্যার পানি নামতে শুরু করলে এসব ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হবে বলে জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যার উদ্ভব হয়েছে। এতে দেশের শাখা-প্রশাখাসহ ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪ হাজার ১৪০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। আগস্ট মাসে আরও বৃষ্টিপাত হবে। এ মাসেই স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতও হবে। তবে মৌসুমি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে মধ্যমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। তবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা দেখা দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর শুক্রবার (৩১ জুলাই) জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবারের তুলনায় শুক্রবার জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা ও ধরলার পানি কখনোই স্থিতিশীল নয়। আটকে থাকে না। পানি বয়ে যায়। তাই এ সময় এই দুই নদীর অতিরিক্ত পানিতে জেলা বন্যাকবলিত হলেও কয়েক ঘণ্টা পর নেমে যায়। এ কারণে এখানকার মানুষ বাড়িতেই থাকে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসে না, তবে সরকারি সহায়তা বাড়িতেই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান এনডিসিসিআর-এর বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, টাঙ্গাইল, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, নওগাঁ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নাটোর, মুন্সীগঞ্জ ও চাঁদপুর জেলায় আগামী ২ দিন বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। এরপর এসব জেলার পানি কমতে পারে। তারপরও সমুদ্রে যদি জোয়ার থাকে তাহলে দেশের মধ্যাঞ্চলে পানি কমতে দেরি হতে পারে। তবে এসব জেলার বন্যার পানি আগস্টের প্রথম সপ্তাহে নামতে শুরু করতে পারে। তিনি বলেন, সরকার সব সময় প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী নিজে বন্যা পরিস্থিতি এবং সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম মনিটর করছেন।