জাতীয় ডেস্ক :
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, চট্টগ্রামের হালদা নদী এবং পদ্মা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র ও এর শাখা নদীগুলোতে বিশ্বের মহাবিপন্ন প্রাণী মিঠাপানির গাঙ্গেয় ডলফিন (শুশুক) ও ইরাবতি ডলফিনের আবাসস্থল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে ডলফিন বিলুপ্তির পথে।
পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে, এই ডলফিনকে মিঠাপানির জাতীয় প্রাণী হিসেবে ঘোষণার দাবি উঠেছে, যেন প্রাণীটি সংরক্ষণে আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে গত বছরের ১২ মে ডলফিন সংরক্ষণে সরকারের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট। কিন্তু তারপরও বাংলায় ডলফিনের টিকে থাকা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
দেশে ডলফিনের অন্যতম বৃহৎ আবাস সুন্দরবনের নদীগুলো। বনটির বিভিন্ন নদী ও খাল থেকে প্রায়ই মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়। সবশেষ গত ১৭ জুলাই শরণখোলা রেঞ্জ থেকে একটি মৃত শুশুক উদ্ধার করা হয়। এর আগে চলতি বছরের ২৭ মে এবং ১১ মার্চ আরও দুটি মৃত শুশুক উদ্ধার করা হয়েছিল।
ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি বাংলাদেশ (ডাব্লিউসিএস বাংলাদেশ) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সুন্দরবন ও এর আশেপাশের এলাকায় তিন প্রজাতির ১০৮টি ডলফিনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। যারমধ্যে ৮০টি শুশুক প্রজাতির, ২৪টি ইরাবতি ডলফিন, ৪টি পাখনাহীন পরপয়েস।
‘আইডেন্টিফাইং ডলফিন হটস্পট ইন সাউথ ইস্টার্ন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে সুন্দরবন এলাকায় ডাব্লিউসিএস পরিচালিত এক সমীক্ষায় সুন্দরবনের নদীগুলোতে ২২৫টি শুশুকের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত সমীক্ষার সুন্দরবনে মাত্র ১৫৯টি শুশুকের খোঁজ পাওয়া যায়।
এছাড়া, ২০০৬ সালের অপর এক সমীক্ষায় সুন্দরবন এলাকায় ৪৫১টি ইরাবতি ডলফিন শনাক্ত হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত সমীক্ষায় সেখানে মাত্র ১৯৮টি ইরাবতি ডলফিন পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, চলতির বছরের ৪ অক্টোবর হালদা নদীতে সর্বশেষ একটি ডলফিনের মৃত্যু হয়।
হালদা নদী গবেষক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, এ নিয়ে চলতি বছর হালদা নদীতে চারটি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে। আর গত চার বছরে হালদা নদী থেকে ৩১টি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে।
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে মাত্র ১২০০টি গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুক আছে। এরমধ্যে হালদা নদীতেই এক সময় প্রায় ২৫০টি ডলফিনের আবাস ছিল। তবে কিন্তু অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, হালদায় ডলফিনের সংখ্যা বর্তমানে ১২৬টি।
এ দুটি পরিসংখ্যান দেশের মিঠাপানির ডলফিন বিলুপ্তির অশনি সংকেত হিসেবেই তুলে ধরে। এছাড়া দেশের পদ্মা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্রসহ এর শাখা নদীগুলো এবং সমুদ্রে ডলফিনের মৃত্যুর সঠিক হিসাব এখনও অজানা।
কেন এত ডলফিন মারা যাচ্ছে?
দেশের নদ-নদীগুলো থেকে দ্রুত ডলফিনের হারিয়ে যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান জানান, বয়সজিনত কারণ ব্যতীত সবচেয়ে বেশি ডলফিনের মৃত্যু হয় জেলেদের ফাঁস জালে আটকা পড়ে। নৌযানের সোনারের আঘাতেও প্রতিবছর অনেক ডলফিনের মৃত্যু হয়। এছাড়া ডলফিনের তেল থেকে ব্যথানাশক ওষুধ তৈরির মতো কুসংস্কার রয়েছে। মাছ ধরার টোপ হিসেবেও ডলফিনের তেলের ব্যবহার করে জেলেরা। এসব কারণেও অনেক সময় ডলফিন শিকার করে জেলেরা।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সাঈদ মুহাম্মদ শরীফ এ বিষয়টির পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, কিছু লোভী জেলে ডলফিন হত্যা করে। কারণ, ডলফিনের পাখনা ওষুধ এবং খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আমি এ পর্যন্ত যতগুলো মৃত ডলফিন দেখেছি, বেশিরভাগেরই পাখনা কাটা ছিল।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন- ২০১২ অনুযায়ী ডলফিন হত্যা করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড বিধান অন্তর্ভুক্ত করা রয়েছে। এ ছাড়া মৃত ডলফিনের দেহাবশেষ অবৈধভাবে কারও কাছে পাওয়া গেলেও সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডই হতে পারে।
কিন্তু ডলফিন জলজপ্রাণী হলেও মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী প্রাণীটিকে সংরক্ষণের কথা বলা হয়নি। ফলে মৎস্য কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন না। অন্যদিকে, প্রাণীটি সংরক্ষণের আইনগত কর্তৃপক্ষ বন বিভাগ হলেও এ জন্য প্রয়োজনীয় জনবল তাদের নেই।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. মহসীন বলেন, মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ অনুযায়ী যে সকল মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে সেখানে ডলফিন বা শুশুক সংরক্ষণের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। সে কারণে জেলেদের জালে ডলফিন ধরা পড়লেও মৎস্য বিভাগ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না।
অন্যদিকে বন বিভাগের জনবল এতই কম যে, বন ও বন্যপ্রাণীর পাশাপশি নদ-নদীতে নজরদারির মতো সক্ষমতা তাদের নেই।
এ বিষয়ে বন বিভাগের ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের পরিচালক ড. জহির আকন বলেন, যে কোনো বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনে ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট কাজ করছে। তবে বিপন্ন বা ডলফিনের মতো মহাবিপন্ন প্রাণী অপরাধ দমনের বিষয়টি ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট শুরু থেকেই খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বিভিন্ন প্রচারণা ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ শূন্যে আনার চেষ্টা করছে ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট।
বাংলাদেশের উপকূল ও নদী এলাকাগুলোতে এখনও ডলফিনের টিকে থাকার মতো পরিবেশ আছে মন্তব্য করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, সুন্দরবনে ডলফিন সংরক্ষণে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। হালদার ডলফিন সংরক্ষণে মৎস্য বিভাগ ও বন্ধ বিভাগের সরব উপস্থিতি রয়েছে। তবে পদ্মা বা যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের ডলফিন সংরক্ষণে আরও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। এর বাইরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের নদ-নদীতে থাকা ডলফিন সংরক্ষণে দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি নেই, আশু বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। এর সঙ্গে অচেতনতায় ডলফিনের মৃত্যু, নদী দূষণ ঠেকানোও সংরক্ষণ কাজের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।
ডাব্লিউসিএসের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সুন্দরবনের ডলফিন সংরক্ষণে বন বিভাগ ও ডাব্লিউসিএস ইতোমধ্যে বেশ সফলতা দেখিয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলে ডলফিন সংরক্ষণ কাজের গতি কিছুটা কম। সবমিলিয়ে দেশের ডলফিন সংরক্ষণে জনগণকে সাথে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
উপ প্রধান বন সংরক্ষক (বন ব্যবস্থাপনা উইং) জাহিদুল কবির বলেন, সুন্দরবনে ডলফিন সংরক্ষণে সরকারি কার্যক্রমের ইতোমধ্যে দারুণ অগ্রগতি হয়েছে, সেখানে ৬টি অভয়ারণ্য ঘোষণার পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ ও জেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি এলাকায় একটি করে স্থানীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে যারা ডলফিন সংরক্ষণে প্রচারণা, প্রশিক্ষণ ও নজরদারি করবে।
তিনি আরও বলেন, হালদার ডলফিন সংরক্ষণে মৎস্য বিভাগ দায়িত্ব পালন করছে যাদেরকে সহায়তা করছে বন বিভাগ। তবে আমাদের বিশেষ নজর এখন পাবনা অঞ্চলের পদ্মা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের ডলফিনের দিকে। সেখানে তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে, সুন্দরবনের সফলতার অভিজ্ঞতা সেখানে কাজে লাগাতে চাই। আশা করছি দীর্ঘ মেয়াদে ডলফিন সংরক্ষণে বন বিভাগ সফলতার দিকেই হাঁটছে।
২০২০ সালে ডলফিন দিবসের বক্তব্যে সুন্দরবনসহ দেশের ৯টি এলাকাকে ডলফিনের অভয়ারণ্য এলাকা ঘোষণার পাশাপাশি প্রাণীটি সংরক্ষণে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। ডলফিন সংরক্ষণে ‘ডলফিন অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরির করা বলেছিলেন তিনি।
তবে নদী দূষণ সংরক্ষণ কার্যক্রমে ব্যাপক বাধা সৃষ্টি করেছে, এটি সমাধানে এবং ঠেকাতে পরিবেশ অধিদপ্তরের আন্তরিক সহায়তা অতি জরুরি। মৎস্য বিভাগের সহায়তাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।