রাজনীতি ডেস্ক:
শীর্ষ পদ ধরে রাখা ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে চাপে পড়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। দলের ভেতরে ও বাইরে থেকে এই চাপ তৈরি হয়েছে তার ওপর। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টিকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে বলেই জানিয়েছেন দলটির শীর্ষ স্থানীয় নেতারা। তবে এই সিদ্ধান্ত আগামী অক্টোবরের আগে প্রকাশ্যে আনতে অনাগ্রহী জাতীয় পার্টির নীতিনির্ধারকেরা।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে কয়েকটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। একটি পক্ষ জিএম কাদের নেতৃত্বাধীন, অন্য একটি ক্ষুদ্র পক্ষ রওশন এরশাদের পক্ষে। তবে এই দুই পক্ষের বাইরে শক্তিশালী আরেকটি পক্ষটি হচ্ছে— যারা কাদের ও রওশন উভয়পক্ষের হয়ে থাকলেও মূলত তারা একাধিক দেশি-বিদেশি সংস্থার স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেন। ফলে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই পক্ষটির অবস্থানকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে জিএম কাদেরকেও নির্বাচনের পক্ষেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে, এমনটি মনে করছেন জাতীয় পার্টির একাধিক শীর্ষ নেতা।
বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) জাপার প্রেসিডিয়ামের একজন সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জিএম কাদেরের ভারত সফরের সময়ই তাকে পদ থেকে সরিয়ে রওশন এরশাদকে স্থলাভিষিক্ত করার পরিকল্পনা ছিল ক্ষমতাসীন দলের একটি প্রভাবশালী পক্ষের। জিএম কাদের যেন নির্বাচনবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম না হন, সে কারণেই ওই উদ্যোগ ছিল।’
জিএম কাদের গত ২০ আগস্ট ভারত সফরে যান। এরপর ২২ আগস্ট রওশন এরশাদের প্রেস উইং থেকে কাজী মামুনুর রশীদ নামে একটি ব্যক্তি রওশন এরশাদ নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন, উল্লেখ করে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান। যদিও ওইদিন সন্ধ্যার সময় আবার রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে বিষয়টি ‘ভুয়া’ বলে অভিহিত করা হয়।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র বলছে, প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া বলা হলেও আদতে সে ধরনের প্রস্তুতিই ছিল। এর আগে গত বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিলেন জিএম কাদের।
গত বছরের ৪ অক্টোবর জাপা থেকে বহিষ্কৃত নেতা দলটির সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা করেন। বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৩১ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের দলীয় যাবতীয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞার অস্থায়ী আদেশ দেন। এরপর ৩০ নভেম্বর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের দায়িত্ব পালনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। এরপর ১৩ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে রায় দেন।
জাপার সিনিয়র একাধিক নেতা জানান, মূলত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ে বিশেষভাবে বক্তব্য রাখেন জিএম কাদের। রাজনীতিতে দল হিসেবে জাতীয় পার্টির একটি স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি বক্তব্য দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয়নি। এছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থা সরকারের বাইরে নেওয়া, দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাসহ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বক্তব্যের কারণে ক্রমাগত চাপ ছিল দেশীয় একাধিক সংস্থার তরফেও। এসব কারণে বর্তমানে ব্যাপক চাপে রয়েছেন জিএম কাদের।
দলের শীর্ষ স্থানীয় একজন নেতা মনে করেন, জাতীয় পার্টির পক্ষে নির্বাচনের বাইরে থাকা অসম্ভব। বিশেষ করে সরকার পতনের দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলন চললেও সেদিকে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আর নেই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল যেহেতু নির্বাচনের পথে অনড়, সে কারণে জাপার নির্বাচনের বাইরে থাকা কঠিন। একইসঙ্গে ইতোমধ্যে দলের সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ জোরেশোরে নির্বাচনি তৎপরতাও শুরু করেছেন।
দলের প্রেসিডিয়ামের প্রভাবশালী একজন সদস্য উল্লেখ করেন, ‘বিএনপি বড় দল, নির্বাচনে না গেলেও টিকে থাকা সহজ। কিন্তু জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না গেলে পার্টির ঐক্য ধরে রাখা কঠিন। রওশন এরশাদকে কেন্দ্র করে এই তৎপরতা চালাতে এরইমধ্যে একটি পক্ষ তৎপর। সে কারণে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনের পথেই যাবে জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে না গেলে দলের ভাঙন আরও একবার অত্যাসন্ন বলে দিল্লিতেও জিএম কাদেরকে অবহিত করা হয়েছে’, বলে জানান এই সদস্য।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া রবিবার (২৭ আগস্ট) বলেন, ‘আমরা গত প্রেসিডিয়ামের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি— আগামী সেপ্টেম্বরের শেষদিকে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডিয়ামের সভায় নির্বাচন বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ওই মিটিংয়ের পরই জানা যাবে কী হবে।’
জানতে চাইলে শুক্রবার (২৫ আগস্ট) রাতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে যাবো কী যাবো না, কীভাবে যাবো, এসব বিষয় দল সিদ্ধান্ত নেবে। দল যখন সিদ্ধান্ত নেবে তখনই জানা যাবে।’
কোনও চাপে আছেন কিনা এসব বিষয়ে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি হেসে উঠেন।