জাতীয় ডেস্ক:
নারায়ণগঞ্জ হয়ে উঠেছে গ্যাস বিস্ফোরণের আঁতুড়ঘর। একের পর এক বিস্ফোরণে মৃত্যুসহ হতাহত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে বিস্ফোরণ আতঙ্ক। পাইপলাইনের লিকেজের কারণেই ঘটছে বিস্ফোরণের ঘটনা। তবে মানুষের অসতর্কতাকেও দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নারায়ণগঞ্জ সদর এলাকাসহ ঘনবসতিপূর্ণ অন্যান্য উপজেলা শিল্পাঞ্চলে রূপান্তরিত হওয়ায় কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে জেলাজুড়ে গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে অনেক।
তিতাসের তথ্যমতে, জেলায় আবাসিক ও শিল্প-বাণিজ্যিকসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এক লাখেরও বেশি গ্রাহক আছে তাদের। পাশাপাশি অবৈধ সংযোগ রয়েছে কয়েক লাখ। এসব বৈধ ও অবৈধ সংযোগে বিভিন্ন এলাকায় লিকেজের আলামত সহসাই চোখে পড়ছে তাদের। এমন বাস্তবতায় অহরহ ঘটছে গ্যাসের বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।
জেলা ফায়ার সার্ভিসের তালিকামতে, নারায়ণগঞ্জে ২০২০ সালে গ্যাসের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড হয়েছে ৩৯টি, ২০২১ সালে ১২৮টি, ২০২২ সালে ৫১টি এবং ২০২৩ সালে এখন পর্যন্ত হয়েছে ৬৭টি দুর্ঘটনা।
চলতি বছরের ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: গত ১২ মার্চ ফতুল্লায় বহুতল ভবনে গ্যাসের বিস্ফোরণে নিহত হন মা ও তার নবজাতক শিশুসন্তান। ১৮ মার্চ শহরের নিতাইগঞ্জে খাদ্যগুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ৩ জন নিহত ও ১০ জন দগ্ধ হন। ২৩ জুলাই ফতুল্লায় একটি বাড়িতে গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ১ জন নিহত ও ২ জন দগ্ধ হন। ২৯ জুলাই ফতুল্লার কাশিপুরে অটোরিকশার শোরুমে বিস্ফোরণে ৩ জন নিহত ও ১৩ জন দগ্ধ হন। ১২ আগস্ট ফতুল্লায় গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ১ জন নিহত ও ৪ জন দগ্ধ হন।
এ ছাড়াও ২০ সেপ্টেম্বর ফতুল্লার নরসিংপুরে একটি ডাইং কারখানায় জেনারেটর রুমে গ্যাসের পাইপলাইন বিস্ফোরণে দুই শ্রমিক দগ্ধ হন। ২৩ সেপ্টেম্বর আড়াইহাজারে একটি বাড়িতে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে দুই নারীসহ চারজনের মৃত্যু হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর ফতুল্লার দেওভোগে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে অন্তঃসত্ত্বা এক নারীর মৃত্যু হয়। ৮ অক্টোবর আড়াইহাজারে গ্যাসের সিলিন্ডারের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে একই পরিবারের একজন নিহত ও দুজন দগ্ধ হন।
সর্বশেষ গত ১৪ অক্টোবর সিদ্ধিরগঞ্জে একটি স্টিল মিলে গ্যাসের কন্ট্রোল রুমে বিস্ফোরণে চার শ্রমিক নিহত হন। দগ্ধ এক শ্রমিক এখনও চিকিৎসাধীন। একের পর এক এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, অধিকাংশ ঘটনার পেছনে গ্যাসলাইনের লিকেজ ও সরবরাহ করা গ্যাসের অতিরিক্ত চাপসহ মানুষের অসতর্কতার প্রমাণ মিলেছে।
এমন দুর্ঘটনা এড়াতে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স-এর উপসহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহাম্মদ সময় সংবাদকে বলেন, যদি কোনো বাড়িতে গ্যাসের লিকেজ থাকে সেক্ষেত্রে তাদের সতর্ক থাকতে হবে। তাদের উচিত হবে তাৎক্ষণিক তিতাস অফিসে অথবা ফায়ার সার্ভিস অফিসে জানানো। একদিকে গ্যাসলাইনে লিকেজ, অন্যদিকে মানুষ সচেতন নয় বলেই বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটছে।
তবে মানুষের অসচেতনতাকেই প্রথম কারণ বলে দাবি করছেন নারায়ণগঞ্জ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোং লিমিটেড-এর উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মামুনার রশিদ।
সাংবাদিকদেরকে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাটে লিকেজ আছে এটা সত্য। সেই লিকেজ থেকে কিন্তু বিস্ফোরণ হয় না।’
তিতাসের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক সময় গ্যাস সংকট থাকে। তখন অনেকে চুলার চাবি ছেড়ে রাখে। গ্যাস আসার পর পুরো ঘরে ছড়িয়ে গ্যাসের চেম্বার হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে বাসার কেউ রান্না করতে চুলায় আগুন দিলে কিংবা লাইট বা ফ্যানের সুইচ অন করলে স্পার্ক করে বিস্ফোরণ হয়। তাই সবার আগে সচেতন হতে হবে। তাহলে দুর্ঘটনা থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি।’
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জে গত চার বছরে গ্যাস সংক্রান্ত ২৮৫টি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছে শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর শহরের তল্লা এলাকায় মসজিদে গ্যাসের পাইপলাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ৩৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা জেলার সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনা।