হোম আন্তর্জাতিক গোপন চিঠির মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকের পথে চীন

গোপন চিঠির মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকের পথে চীন

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 80 ভিউজ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধকে আরও তীব্র করছিলেন, তখনই বেইজিং নীরবে নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের প্রচেষ্টা শুরু করে।

ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে একটি গোপন চিঠি পাঠান। যদিও মুর্মু আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান, সেই বার্তাটি মূলত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়েছিল। চিঠিতে এমন সব মার্কিন চুক্তি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়, যা চীনের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

সূত্রগুলো জানাচ্ছে, জুন মাসের আগে মোদি প্রশাসন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় টানাপোড়েন চলছিল, পাশাপাশি ট্রাম্পের ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি নিয়ে সরব হওয়ায় নয়াদিল্লি বিরক্ত ছিল। তবে আগস্ট থেকে চিত্র পাল্টাতে শুরু করে। ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত শুল্কে ভারতীয় অর্থনীতি চাপে পড়ার পর দুই দেশ ২০২০ সালের প্রাণঘাতী সীমান্ত সংঘর্ষের পরে অমীমাংসিত সীমান্ত বিরোধ মেটাতে আলোচনা জোরদার করতে সম্মত হয়। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী মোদি সাত বছর পর প্রথমবার চীন সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি

ভারত-চীনের এই ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে দিল্লিকে বেইজিংয়ের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প হঠাৎ ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০% শুল্ক বসিয়ে সেই কৌশলকেই দুর্বল করে দেন। কারণ, ভারত রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত রেখেছিল। কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো অ্যাশলে টেলিস ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘ট্রাম্প আসলেই মহা শান্তিদূত—ভারতকে শত্রুতে পরিণত করে তিনি দিল্লি ও বেইজিংকে আবার কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন।’

সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পটভূমি

মোদি সরকার বহুদিন ধরেই চীনের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর উপায় খুঁজছিল। শাসক দলের কর্মকর্তাদের যুক্তি ছিল, সম্পর্ক উন্নত হলে দুর্বল অর্থনীতিতে গতি আসবে এবং সীমান্তে সামরিক মোতায়েনের বিপুল ব্যয়ও কমানো যাবে। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে দুই দেশ কাছাকাছি এসেছিল, যদিও কয়েকটি জটিলতা চুক্তি চূড়ান্ত হতে বাধা দেয়।

এ বছরের মার্চে শি জিনপিং রাষ্ট্রপতি মুর্মুকে চিঠি পাঠানোর পর চীনা নেতৃত্ব প্রকাশ্যে ‘ড্রাগন–এলিফ্যান্ট ট্যাঙ্গো’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে শুরু করে। ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যান ঝেংসহ একাধিক শীর্ষ নেতা একই বক্তব্য দেন। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এই প্রক্রিয়ার অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে উঠে এসেছেন। তিনি সীমান্ত আলোচনার বিশেষ প্রতিনিধি এবং ইতোমধ্যেই একাধিকবার বেইজিং সফর করেছেন।

জুলাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর পাঁচ বছর পর প্রথমবারের মতো বেইজিংয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে জয়শঙ্কর চীনকে বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা দূর করার আহ্বান জানান। জবাবে চীন ভারতকে সার ও রেয়ার আর্থ সরবরাহের আশ্বাস দেয়।

সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে কয়েকটি উদ্যোগ ইতিমধ্যেই গৃহীত হয়েছে। আগামী মাস থেকে দু’দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু হবে। চীন ইউরিয়া সরবরাহ সহজ করেছে এবং ভারত চীনা নাগরিকদের জন্য পর্যটন ভিসা পুনরায় চালু করেছে। ব্লুমবার্গ আরও জানিয়েছে, আদানি গ্রুপ চীনের বৈদ্যুতিক যান নির্মাতা বিওয়াইডির সঙ্গে অংশীদারিত্বের আলোচনায় রয়েছে। একইসঙ্গে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এবং জেএসডব্লিউ গ্রুপও চীনা সংস্থাগুলোর সঙ্গে গোপন চুক্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে।

গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে ওয়াং-এর সঙ্গে বৈঠকের পর মোদি প্রকাশ্যে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে স্বাগত জানান। আগামী ১ সেপ্টেম্বর সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনের ফাঁকে শি ও মোদির বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও বড় কোনো চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবু পার্শ্ববৈঠকে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হতে পারে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে চীন–ভারত ঘনিষ্ঠতার যৌক্তিকতা স্পষ্ট। চীনে মুদ্রাস্ফীতি কমছে এবং তাদের বৈদ্যুতিক গাড়ি ও সৌর প্যানেলের মতো শিল্প অতিরিক্ত উৎপাদনে ভুগছে। অন্যদিকে, বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী নিয়ে ভারত চীনের জন্য বড় বাজার হতে পারে। তবে মার্কিন শুল্ক যদি বহাল থাকে, তবে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ৬০% কমতে পারে এবং এর ফলে জিডিপি প্রায় ১% হ্রাস পেতে পারে।

কিন্তু সন্দেহও কম নয়। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা এখনও দিল্লির বড় উদ্বেগ। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এপ্রিলে সীমান্তে সংঘর্ষের সময় চীন পাকিস্তানকে বিমান প্রতিরক্ষা ও স্যাটেলাইট সহায়তা দিয়েছিল। একইভাবে, ভারত যদিও তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয় না, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্য ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বেইজিংকে অস্বস্তিতে ফেলছে।

এছাড়া দালাই লামার উত্তরাধিকার ইস্যুও নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। বেইজিং দাবি করছে, ১৯৫০ সালের এক রাজকীয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরবর্তী দালাই লামার নির্বাচন তাদের অনুমোদন সাপেক্ষে হবে।

ভবিষ্যত সম্ভাবনা

সব জটিলতার মাঝেও সম্পর্ক উন্নয়নের পথ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। মুম্বাইয়ে চীনের কনস্যুলেটে কর্মরত সাবেক কূটনীতিক কুই হংজিয়ান মনে করেন, শি সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নেবেন এবং সম্পর্ক সুসংহত হলে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে শি মোদির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেটি সফল হয়নি’।

ইউরেশিয়া গ্রুপের সিনিয়র বিশ্লেষক জেরেমি চ্যান বলেন, ‘ভারত–চীন সম্পর্ক নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পথে রয়েছে, তবে তারা মূলত অতীতের ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে। এখান থেকে আরও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করা কঠিন হবে।’

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন