হোম আন্তর্জাতিক গাজায় সংঘাত: জাতিসংঘ সনদের ৯৯ ধারা প্রয়োগে কি শান্তি ফিরবে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

হামাসের সঙ্গে সংঘাত দুই মাসে গড়ালেও ফিলিস্তিনের গাজায় একটুও কমেনি ইসরাইলের বর্বর হামলা। নির্বিচার বোমাবর্ষণ, নিরীহ মানুষকে হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করা, খাবার ও চিকিৎসার জন্য হাহাকার—সব মিলিয়ে উপত্যকাটির পরিস্থিতি ‘কেয়ামতের মতো’ বলছে জাতিসংঘ। এ অবস্থায় এক বিরল পদক্ষেপ নিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সংঘাত অবসানে নিরাপত্তা পরিষদকে সক্রিয় হতে গত বুধবার (৬ ডিসেম্বর) জাতিসংঘ সনদের ৯৯ ধারা প্রয়োগ করেছেন তিনি।

বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্মম নিপীড়ন, ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে অবৈধ বসতি ও পবিত্র আল আকসা মসজিদের অবমাননার জবাবে গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে আকস্মিক অভিযান চালায় ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী গোষ্ঠী হামাস। এরপরই হামাসকে উৎখাতের নামে গাজায় আগ্রাসন শুরু করে ইসরাইল। শুরু হয় নির্বিচার ও বিরামহীন হামলা, যা গত দুই মাস ধরে অব্যাহত রয়েছে।

এই হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা এরই মধ্যে ১৭ হাজার ছাড়িয়েছে, যাদের অর্ধেকই নারী ও শিশু। আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজারে। উপত্যকার ২৩ লাখ অধিবাসীর ৮০ শতাংশই উদ্বাস্তু বা শরণার্থী হয়েছে। মাটিতে মিশে গেছে ৬০ শতাংশ বাড়িঘর। গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ও নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যায় ইসরাইলকে সর্বাত্মক সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো।

এদিকে সংঘাত বন্ধে সেই শুরু থেকেই গাজায় ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’র দাবি জানিয়ে আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস। কিন্তু স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর মধ্যকার মতদ্বন্দ্বের কারণে এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করেনি নিরাপত্তা পরিষদ। গাজা সংঘাতে ইসরাইলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের ভোটে একটি প্রস্তাব ভেস্তে গেছে।

অন্যদিকে আরেকটি প্রস্তাব আটকে দিয়েছে ইসরাইলের নীতির কঠোর সমালোচক রাশিয়া। গাজা সংকটে স্থায়ী দেশগুলোর পক্ষ থেকে যখন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না, তখন জাতিসংঘ সনদের ৯৯ ধারার আশ্রয় নিলেন মহাসচিব গুতেরেস। প্রশ্ন হলো: ৯৯ ধারা কী, আর গাজায় সংঘাত বন্ধে এই ধারা আসলে কতটা কার্যকর?

৯৯ ধারা কী?
এটি একটি বিশেষ ক্ষমতা এবং জাতিসংঘ সনদে মহাসচিবকে দেয়া একমাত্র স্বাধীন রাজনৈতিক হাতিয়ার। ৯৯ ধারা অনুযায়ী, মহাসচিবের বিবেচনায় কোনো বিষয় আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে হলে তিনি নিজ উদ্যোগে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের নজরে এনে বৈঠক আহ্বান করতে পারেন।

গত ৩৪ বছরে (১৯৮৯ সালের পর) জাতিসংঘের কোনো মহাসচিব ধারাটি ব্যবহারের প্রয়োজন মনে করেননি। আর ২০১৭ সালে মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে কখনও এ ধারা ব্যবহার করেননি গুতেরেস। তবে গাজায় ইসরাইলের নজিরবিহীন আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে এবার ধারাটি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

৯৯ ধারা হলো একটি বিশেষ ক্ষমতা এবং জাতিসংঘ সনদে সংস্থাটির মহাসচিবকে দেয়া একমাত্র স্বাধীন রাজনৈতিক হাতিয়ার।

৯৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘মহাসচিব যে কোনো বিষয় নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টিতে আনতে পারেন যা তিনি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য হুমকি হতে পারে বলে মনে করেন।’

ধারাটি প্রয়োগের ফলে এখন গুতেরেসের নিরাপত্তা পরিষদে বক্তৃতা করার অধিকার থাকবে।

গুতেরেস কেন এই আহ্বান জানালেন?
নিরাপত্তা পরিষদের কাছে লেখা এক চিঠিতে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন গুতেরেস। তিনি জানিয়েছেন, গাজা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি এবং এ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের পদক্ষেপের ঘাটতির কারণেই তিনি ৯৯ ধারা প্রয়োগ করেছেন। নিরাপত্তা পরিষদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে তিনি জানান, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বর্তমানে যেসব হুমকি রয়েছে, তা ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

চিঠিতে তিনি সতর্ক করেছেন যে, গাজায় এরই মধ্যে ত্রাণ সহায়তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। শিগগিরই জনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে পারে। বেসামরিক নাগরিকদের কোনো কার্যকর সুরক্ষা নেই। গাজায় কোথাও নিরাপদ জায়গা নেই। তিনি আরও বলেছেন, ‘পরিস্থিতি দ্রুতই বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। যেখান থেকে ফেরা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।’

৯৯ ধারায় কি সংঘাত থামবে?
নিরাপত্তা পরিষদকে জাতিসংঘের সবচেয়ে প্রভাবশালী অঙ্গ সংস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট সংস্থাটির কাজ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা। সংস্থাটি যদি গুতেরেসের পরামর্শমতো কাজ করে এবং একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণ করে, তবে বলা যায় সংঘাত বন্ধ হবে। কারণ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ক্ষমতা বা আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের অনুমোদন করার মতো এর আরও কিছু ক্ষমতা রয়েছে এবং প্রস্তাব বাস্তবায়নে সেগুলো ব্যবহার করা সম্ভব।

তবে ৯৯ ধারায় প্রস্তাব গ্রহণে নিরাপত্তা পরিষদকে বাধ্য করার মতো কোনো ক্ষমতা মহাসচিবের নেই। তিনি যেটা করতে পারেন, সেটা হলো স্থায়ী সদস্য দেশগুলোকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে পারেন এবং একটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে উৎসাহিত করতে পারেন। যেমনটা বলছেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও পররাষ্ট্র বিষয়ের অধ্যাপক অ্যান্থনি আরেন্ড।

গাজায় নিহতের সংখ্যা এরই মধ্যে ১৭ হাজার ছাড়িয়েছে, যাদের অর্ধেকই নারী ও শিশু। ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক আরেন্ড বলেন, ‘তিনি জোর করে আলোচনায় বসাতে পারেন, তিনি দলগুলোকে একত্রিত করতে পারেন এবং কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে উৎসাহিত করতে পারেন। যেহেতু পাঁচটি দেশের ভেটো ক্ষমতা আছে, সে ক্ষেত্রে এই ইস্যুতে একটি সারগর্ভ প্রস্তাব গ্রহণ করার একমাত্র উপায় হলো পাঁচটি দেশের প্রত্যেককে ভেটো না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

ভেটো ক্ষমতাওয়ালা পাঁচ দেশ হলো চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। গাজা ইস্যুতে গত ১৮ অক্টোবর আনা একটি প্রস্তাবে ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রস্তাবে ইসরাইলে হামাসের হামলার নিন্দা, গাজায় ইসরাইলের হামলায় বিরতি ও মানবিক ত্রাণ সহায়তা প্রবেশের আহ্বান জানানো হয়। ১২টি দেশ সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। অন্যদিকে রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য ভোটদানে বিরত থাকে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন