আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
টেক্সাসের স্কুলে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে তুলসা হাসপাতালে এলোপাতাড়ি গোলাগুলি। এ ছাড়াও খবর না-হওয়া আরও অনেক ঘটনা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ বন্দুক সহিংসতায় দেশটির পুলিশ বিভাগের পুরোনো একটি দাবি আবার নতুন করে সামনে চলে আসছে—‘উষ্ণ আবহাওয়ায় বন্দুক সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড বাড়ছে’।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির বিশ্লেষণ বলছে, কয়েক দশক ধরে অপরাধ বিষয়ক গবেষকরা এই সংযোগের কথা বলে আসছিলেন। তাপমাত্রা ও অপরাধের মাত্রার নিখুঁত সম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাও এমনটি বলছে। যারা এ প্রশ্নটি নিয়ে লেখাপড়া করছেন, সাধারণ জ্ঞানের পাশাপাশি তাদের স্পষ্ট কলাকৌশল যে বেশি আছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু আবহাওয়ার উষ্ণতার সঙ্গে সহিংসতার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে হরদম।
খারাপ কিংবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বন্দুক সহিংসতা কেন কম হয়, সেই ব্যাখ্যা দিলেন হার্ভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের স্বাস্থ্যনীতির অধ্যাপক ডেভিড হেমেনওয়েই। তিনি বলেন, প্রথমত, যদি কেউ বাইরে না-ই থাকেন কিংবা বের না হন, তবে কাউকে গুলি করা যায় না।
অর্থাৎ, বাজে আবহাওয়ায় মানুষের উপস্থিতি কম বলে অপরাধ তৎপরতাও বেশি ঘটছে না বলে তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ধারণাটি অনেক বেশি বিতর্কিত। তার মতে, তাপ নিজেই সম্ভবত সংঘাতকে তীব্রতর করে তোলে। সবচেয়ে বড় কথা, গরম মানুষকে বাইরে থাকতে উৎসাহিত করে।
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতার জোয়ারের নেপথ্যে আরও বহু কারণ আছে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে অপরাধপ্রবণতায় বড় ভূমিকা রাখছে আবহাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনে দ্রুতই উষ্ণায়ন ঘটছে। বাড়ছে দাবদাহ।
ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তর-দক্ষিণ, সেই সঙ্গে স্ক্যান্ডেনেভিয়ার উত্তর ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ এবং দক্ষিণ ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে তাপ ও উচ্চ-অপরাধপ্রবণতার সম্পর্ক নিয়ে আগ্রহী ছিলেন ডেভিড হেমেনওয়েই।
২০২০ সালে স্নাতকের শিক্ষার্থী পল রিপিংকে সঙ্গে নিয়ে ‘আহত মহামারিবিদ্যা’ নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। অপরাধ নিয়ে ধারণা পেতে ২০১২ ও ২০১৬ সালে তারা পুরো শিকাগো শহর তন্ন তন্ন করে ঘুরে দেখেন।
নিবন্ধটিতে দৈনিক গোলাগুলির সংখ্যা নিয়ে শিকাগো ট্রিবিউনে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনও কাজে লাগানো হয়েছে। পরে দৈনিক উচ্চ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুর গতি, ঐতিহাসিক গড়ের সঙ্গে তাপমাত্রার ফারাক, বৃষ্টিপাতের ধরন ও পরিমাণের সঙ্গে মেলানো হয়েছে।
এতে দেখা গেছে, সপ্তাহের ছুটি ছাড়া বাকি দিনগুলোতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে গোলাগুলি ৩৪ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। আর ছুটির দিনে গোলাগুলি বেড়েছে ৪২ শতাংশ।
আর তাপমাত্রা গড় হিসাবের চেয়ে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে গোলাগুলির মাত্রা ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক আছে। অন্য কথায়, ডেভিড হেমেনওয়েই বলেন, এখানে তাপ এমন কিছু নয়, যা উল্লেখযোগ্য; বরং আপেক্ষিক তাপের কথা বলা হচ্ছে। যেমন, গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বেশি গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। শীতে যা অনেকটা কম।
ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াহ শিনাসির নেতৃত্বাধীন আরেকটি গবেষণা নিবন্ধ ২০১৭ সালে আরবান হেলথ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। এতে ফিলাডেলফিয়ায় সহিংস অপরাধের ওপর অনুসন্ধান চালানো হয়েছে।
লিয়াহ শিনাসি বলেন, ‘আমি ফিলাডেলফিয়ায় বাস করছি। উত্তপ্ত দিনগুলোতে বাইকে করে কর্মস্থল থেকে বাড়িতে ফেরার দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। তখন লোকজনকে অনেক বেশি উদ্ভট খেয়ালি বলে মনে হচ্ছিল। উত্তপ্ত দিনগুলোতে অপরাধের উচ্চমাত্রার যোগসাজশ আছে কি না, সেই সম্পর্ক খুঁজতে এই পর্যবেক্ষণ কাজে লাগাতে চেষ্টা করলাম।’
সহলেখক ঘাসান হামরাকে নিয়ে তিনি গবেষণায় নেমে যান এবং জানতে পারেন যে উষ্ণ মাসগুলোতে অনেক বেশি সহিংস ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে সেপ্টেম্বরে। তপ্ত দিনগুলোতে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। এপ্রিল থেকে অক্টোবরের শীতল মাস ও দিনগুলোর সঙ্গে তুলনা করে এই সমীকরণ বের করা হয়েছে।
এ সময় তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছালে দৈনিক সহিংসতার মাত্রা ১৬ শতাংশ বেড়ে যায়। অথচ ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসের দিনগুলোয় যা অনেক কম থাকে।
অধ্যাপক ডেভিড হেমেনওয়েই বিশ্বাস করেন, অনেক বেশি লোক বাইরে থাকলে মানুষের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বৈরিতার শঙ্কাও বেশি থাকে। মানুষকে আগ্রাসী করে তোলে গরম। কাজেই এই দুই অনুমান সত্য বলে ধরে নেয়া যায়।
২০১৯ সালে ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চে এই চমৎকার নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। কেনিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গরম এবং ঠান্ডা কক্ষে রেখে তাদের আচরণ পর্যালোচনা করে লেখা হয়েছে এটি।
দেখা যাচ্ছে, অন্যদের বিভিন্ন জিনিসপত্র স্বেচ্ছায় ভেঙে ফেলতে শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করছে তাপ। হেমেনওয়েই স্বীকার করেন, যখন বন্দুক সহিংসতার কথা আসে, তখন তাপমাত্রার চেয়েও সার্বিক পরিস্থিতি তাতে বড় ভূমিকা রাখে।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৯ কোটি ৩০ লাখ বন্দুক মানুষের হাতে চলে গেছে, যা দেশটির সংখ্যার চেয়েও বেশি। এমনকি অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা কঠোর না করে, কয়েকটি রাজ্যে আরও শিথিল করা হয়েছে, যা সহিংসতায় ইন্ধন জোগাচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
কিন্তু আবহাওয়ার সঙ্গে সহিংসতার সম্পর্ক খোঁজার মধ্যে একটি নীতিগত প্রভাব আছে। বিশেষ করে, রাস্তা, অলিগলিতে তরুণদের আনাগোনা কমিয়ে আনতে হবে এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ওপর ভিত্তি করে সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোতে পুলিশের উপস্থিতি বাড়াতে হবে।
এসব তৎপরতাকে ক্ষতি কমিয়ে আনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অধ্যাপক হেমেনওয়েই। তিনি বলেন, ‘যদি এটি বন্দুক সমস্যাও না হতো, আমার সন্দেহ, তবুও আমরা মারামারি, হামলা-মামলার খবর পেতাম। কিন্তু বন্দুক এসব ঘটনাকে আরও প্রাণঘাতী রূপ দিচ্ছে।’