জাতীয় ডেস্ক :
বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার কথা বলে গত শুক্রবার (৫ আগস্ট) রাতে হঠাৎ তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় সরকার। কিন্তু জ্বালানির দাম বৃদ্ধির আগে গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করে না দেয়ায় দেশব্যাপী ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সমালোচনার মুখে পরদিন (৬ আগস্ট) তড়িঘড়ি করে বাস মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), তেলের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে বাসভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা আসে।
ঘোষণা অনুযায়ী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে বাসভাড়া ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়, যা পরদিন থেকেই কার্যকর হয়। এ ছাড়া প্রতিটি বাসে বাধ্যতামূলক বাসভাড়ার তালিকা টাঙানোর কথাও বলা হয়। কিন্তু রাজধানীর বাসযাত্রীদের অভিযোগ, অনেক বাসেই ভাড়ার চার্ট নেই। এ ছাড়া যেসব বাসে ভাড়ার তালিকা আছে, সেটিও মানছে না পরিবহন শ্রমিকরা, ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার অতিরিক্ত বাসভাড়া আদায়ের কৌশল হিসেবে রুটের প্রকৃত দূরত্ব বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগও উঠেছে।
বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) রাজধানীর মিরপুর, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, নিউমার্কেট, নতুন বাজার, পল্টন, গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ী এলাকা ঘুরে এসব অভিযোগের পাশাপাশি প্রতিক্ষেত্রেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ যাত্রীরা।
নৈরাজ্যের চিত্র যেমন
মোহাম্মদপুরের বছিলা বাসস্ট্যান্ড থেকে চাকরির প্রয়োজনে প্রতিদিন সিটি কলেজ বাসস্ট্যান্ডে যাতায়াত করেন রিদওয়ান রাব্বী। তিনি জানান, বছিলা থেকে সিটি কলেজের দূরত্ব ৫.৯ কিলোমিটার। আগে নগর পরিবহনে এই দূরত্বে ভাড়া নেয়া হতো ১৪ টাকা। কিন্তু অন্য বাসগুলো ভাড়া আদায় করত ২০ টাকা, যা প্রকৃত ভাড়া থেকে ৬ টাকা বেশি। তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে নগর পরিবহন ভাড়া নিচ্ছে ২০ টাকা। কিন্তু কিলোমিটারপ্রতি ২.৫০ টাকা হলেও মোট ভাড়া হয় ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা। অন্যদিকে, রজনীগন্ধাসহ বেসরকারি অন্য বাসগুলো এই ভাড়া নিচ্ছে ২৫ টাকা! অর্থাৎ, সরকার-নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও ১০ টাকা ২৫ পয়সা বেশি নিচ্ছে তারা।
তিনি বলেন, ‘এখন তো বাসে প্রতিদিন যাত্রীদের সঙ্গে বাস শ্রমিকদের ঝগড়া-ফ্যাসাদ হচ্ছে। কিন্তু এসব আর ভালো লাগে না। কিন্তু সরকারই যখন আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে, তখন এর প্রতিকার কার কাছে চাইব? তাই বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করছি।’
মিরপুর-১ নম্বর থেকে বাংলামোটর বাসস্ট্যান্ডে তানজিন পরিবহনে এসে নামেন আবু সাঈদ নিশান নামে এক ব্যক্তি। তিনি ২৫ টাকা বাসভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ ৮.৪ কিলোমিটার পথের ভাড়া হওয়ার কথা ছিল ২১ টাকা।
নিশান বলেন, ‘গত তিন দিন এই ভাড়ায়ই যাতায়াত করছি। তারা আমাদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। কিন্তু যাত্রীদের এই জিম্মিদশার পক্ষে কথা বলার তো কেউ নেই।’
মৌচাক থেকে বাংলামোটরের দূরত্ব ২.২ কিলোমিটার। এই পথের দূরত্ব সর্বনিম্ন ভাড়া হিসেবে ১০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু এমএম লাভলী পরিবহনে সুমাইয়া সুলতানা পায়েলকে প্রতিদিন দিতে হচ্ছে ১৫ টাকা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাসের লোকজনের কথাবার্তা ভালো না। কিছু বললে খারাপ ব্যবহার করে, অপমান করে। তাই যা চায় বাধ্য হয়ে তা-ই দিয়ে দিচ্ছি।’
তবে যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান এসে নামা আশরাফ নামের এক ব্যক্তি যে ঘটনা জানালেন সেটি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি জানান, যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। সর্বনিম্ন ভাড়া হিসেবে এটিও ১০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু চার্টে দূরত্ব ২ কিলোমিটার বাড়িয়ে ৫ কিলোমিটার দেখানো হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী ভাড়া ১৩ টাকা আদায় করা হচ্ছে!
আশরাফ বলেন, বেশি ভাড়া আদায় করতে ৩ কিলোমিটার পথকে ৫ কিলোমিটার দেখানো হয়েছে, অথচ ওই চার্টে বিআরটিএর কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর রয়েছে! বিআরটিএ কর্মকর্তারা কিছু না দেখেই স্বাক্ষর করেছেন–সেটি অবিশ্বাস্য!
কী বলছে সড়ক পরিবহন আইন
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৩৪ অনুচ্ছেদের গণপরিবহনের আসনসংখ্যা ও ভাড়া নির্ধারণ অংশে বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষ, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, গণপরিবহণের জন্য ভাড়ার হার ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ বা পুনর্নির্ধারণ করিতে পারিবে। কোনো গণপরিবহন, সহজে দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন ব্যতীত, যাত্রী পরিবহন করিতে পারিবে না। কোনো গণপরিবহণের মালিক, চালক, কন্ডাক্টর, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করিতে পারিবে না।’
কিন্তু কোনো গণপরিবহনের মালিক, চালক বা কন্ডাক্টর যদি সরকার-নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত দাবি করে তবে তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে বলে বলেও আইনে উল্লেখ আছে। এ বিষয়ে আইনের একাদশ অধ্যায়ে অপরাধ, বিচার ও দণ্ড অংশে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৩৪-এর উপধারা (৩) ও (৪)-এর বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহা হইলে উক্ত লঙ্ঘন হইবে একটি অপরাধ, এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ১ (এক) মাসের কারাদণ্ড, বা অনধিক ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং, চালকের ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক ১ (এক) পয়েন্ট কর্তন হইবে।’
কিন্তু গত কয়েক দিনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে রাইদা, আজমেরী, নূরে মক্কা ও প্রজাপতি পরিবহনের কয়েকটি বাসকে নামমাত্র জরিমানা করা ব্যতীত আর কোনো শাস্তি হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি।
যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর ভাষ্য
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণেও ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু বিআরটিএ নামমাত্র অভিযান পরিচালনা করছে। যাতে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও হচ্ছে না, যাত্রীদের স্বার্থও সংরক্ষিত হচ্ছে না।’
দূরত্ব বাড়িয়ে দেখানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমরাও পেয়েছি। বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি।’
অন্যদিকে যাত্রী অধিকার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক অন্তু মুজাহিদ মনে করেন, এসব অভিযান কেবলই লোক দেখানো। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ২ কোটি মানুষের শহরে বিআরটিএ প্রথমদিনে মাত্র ১২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং হাস্যকর। এর মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থার ওপর কোনো প্রভাব পড়ছে না।
তিনি বলেন, যাত্রীদের নিয়ে-যে সরকার ভাবছে না, তেলের বর্ধিত দাম কার্যকরের আগেই বাসভাড়া নির্ধারণ না করে দেয়া এবং সৃষ্ট বর্তমান বিশৃঙ্খলাই তার প্রমাণ।
বিআরটিকে দুষছে মালিকপক্ষ
যাত্রীদের অভিযোগ থাকলেও ভাড়া নিয়ে লাব্বাইক পরিবহনের সুপারভাইজার রাজু বলেন, ‘আমরা তালিকা অনুযায়ী ভাড়া আদায় করছি। বেশি নিচ্ছি না।’
অন্যদিকে, মোহাম্মদপুর থেকে চিটাগং রোডে চলা রজনীগন্ধা বাসের সুপারভাইজার ফাহাদ বলেন, ‘দূরত্বের বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। আমরা নিয়ম মেনে ভাড়া নিচ্ছি। তবুও যাত্রীরা তা দিতে চাচ্ছেন না।’
এদিকে যাত্রীদের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
তিনি বলেন, ‘গত সোমবার (৮ আগস্ট) বিআরটিএর পুনর্নির্ধারিত বাসভাড়া কার্যকর করাসহ সাংগঠনিক বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় না করতে। আমরা সেটিই মেনে চলছি।’
তবে ভাড়া বাড়াতে দূরত্ব বাড়িয়ে দেখানোর বিষয়ে বিআরটিএ-কে দায়ী করেন খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি বিআরটিএ কর্মকর্তারাই ভালো বলতে পারবেন। দূরত্ব আর ভাড়ার চার্ট তারাই তৈরি করেছে। আপনি তাদের বিষয়টি জিজ্ঞাসা করুন। এ নিয়ে আমরা কিছু জানি না।’
ধরাছোঁয়ার বাইরে বিআরটিএ
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে বিআরটিএ-র পরিচালক নুর মোহাম্মদ মজুমদারের অফিসের টেলিফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। সবশেষে তার অফিস সহকারী টেলিফোন রিসিভ করে বলেন, ‘স্যার ব্যস্ত আছেন। এখন কথা বলতে পারবেন না।’
অন্যদিকে, সংস্থাটির উপপরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. হেমায়েত উদ্দিনের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনেও একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে সংস্থাটির উপপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভাড়া কার্যকর ও যাত্রীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ইতোমধ্যে কয়েকটি পরিবহনকে জরিমানা করা হয়েছে।
তবে দূরত্ব বাড়িয়ে দেখানোর বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে এ বিষয়টি দেখাশোনা করে এনফোর্সমেন্ট শাখা। আপনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারাই বিষয়টি ভালোভাবে বলতে পারবে।’