হোম এক্সক্লুসিভ করোনা আক্রান্ত পরিবারের প্রতি এ কেমন নিষ্ঠুর আচরণ !

করোনা আক্রান্ত পরিবারের প্রতি এ কেমন নিষ্ঠুর আচরণ !

কর্তৃক
০ মন্তব্য 353 ভিউজ

পড়ন্ত বিকালে সহকর্মী নিজামের আগ্রহে অফিস থেকে বের হলাম। ড্রাইভার সমীরকে পেলাম না। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে ছুটতে লাগলাম। উদ্দেশ্য সাতক্ষীরা সদর উপজেলার রাজনগর। কারণ সাতক্ষীরা জেলার প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী মাহফুজুর রহমান সুমনের পৈত্রিক বাড়ি খুঁজে বের করা। গ্রামের অলিগলি পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম তার পৈত্রিক ভিটায়। দেখে মনে হল গ্রামের বনেদী ধনী পরিবার। দোতলা বাড়ি। বাড়ির আঙ্গিনায় কয়েকটি ধানের গোলা চোখে পড়ল।

ওই বাড়িতে ঢুকতেই সুমনের পিতা ও তার ছোট ভাই বারান্দায় বেরিয়ে এলো। ওদের চোখে মুখে ছিল হতাশার ছাপ। নিজেরাই নিজেদেরকে অপরাধী মনে করছিল। কথা বলতে যেন তাদের সংকোচ বোধ করছিল। যশোর জেলার শার্শা উপজেলায় স্বাস্থ্য বিভাগে কর্তব্যরত ছিলেন মাহমুদুর রহমান সুমন। করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজে যে ভাইরাসের আক্রান্ত হবেন, সেটাই তার ধারনাই ছিল না।

কিন্তু দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে সুমন বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। মেডিকেল রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর কর্মস্থল থেকে সে চলে আসে তার গ্রামের বাড়ি রাজনগর গ্রামে। তিন দিন গ্রামের বাড়িতে অবস্থানের পর সে ফিরে আসে সাতক্ষীরা শহরের উত্তর কাঠিয়া ভাড়া বাড়িতে। প্রশাসন তার গ্রামের বাড়ি ও শহরের ভাড়াবাড়ি টি লকডাউন করে দিয়েছে। খবরের সন্ধানে ছুটে যাওয়া রাজনগর গ্রামে। আরেক সহকর্মী সোহাগকে নিয়ে রিপোর্ট তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কিছুটা অসহায়ের সুরে কথা বলছিল সুমনের বৃদ্ধ পিতা।

গ্রামের ধনী পরিবার। একসময় ইউপি মেম্বারেরও দায়িত্বে ছিলেন। ছেলের করোনা আক্রান্তের খবর শুনে প্রতিবেশীরা ওই পরিবারের প্রতি অবহেলা করছে। সমাজের দাপটশালী ও অর্থশালী ওই পরিবার আজ যেন সব হারিয়ে ফেলেছে। কিছুটা করুণার সুরে সুমনের পিতা বলল, আর্সেনিকমুক্ত ৫২পাইপের কলের পানি আনতে যেতে পারছে না তার পরিবারের কেউ। প্রতিবেশীরা ওই পরিবারকে ৫২পাইপের কলের পানি আনতে নিষেধ করেছে। সাহস যোগালাম। আপনার সন্তান রোগাক্রান্ত মানুষের সেবা করতে গিয়ে নিজেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। সে একজন স্বাস্থ্য কর্মী।

এবং জেলার প্রথম করোনা যোদ্ধা । ভদ্রলোক আমার কথায় মনে কিছুটা সাহস পেল। বারান্দা থেকে উঠানে নেমে আসলেন। নিরাপদ দূরত্ব থেকে কথা বলে তাকে সাহস জুগিয়েছি। কিন্তু তিনি বারবার বলছিলেন,হায়রে গ্রামের লোকজন পানি বন্ধ করে দিল! প্রতিউত্তরে বলছিলাম প্রতিবেশীরাই আপনার বাড়ির গেটের সামনে পানি পৌঁছে দেবে। এটাই হলো মানুষের সামাজিক দায়িত্ব। সুমনের পিতা অসহায়ের সুরে বলছিল, আশেপাশের লোকজন যার কথায় উঠতো- বসতো তারা এখন অবহেলা করছে।

ওই পরিবারের অসহায়দৃশ্য দেখে মনে হলো আমরা এ কোন সমাজে বসবাস করছি ? কথা দিয়ে এসেছিলাম, বিষয়টি প্রশাসনকে জানাব। কিন্তু সুমনের পিতার কথা কাজের মাঝে ভুলে গিয়েছিলাম। ঘুমাতে যাওয়ার আগে চোখপরল করোনা বিজয়ী এক পুলিশ কনস্টেবলের মর্মবেদনা দিয়ে লেখা এক আবেগঘন স্ট্যাটাস। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্তব্যরত ওই কনস্টেবল সর্দি কাশি নিয়ে বগুড়ায় তার গ্রামের বাড়ি ফিরে আসে। তখনো রিপোর্ট হাতে আসেনি।

ওই পুলিশ কনস্টেবল গ্রামের বাড়িতে অবস্থানকালেই করোনা ভাইরাসের পজিটিভ রিপোর্ট তার হাতে আসে । এ খবর মূহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের লোকজন ওই পুলিশ কনস্টেবলের বাড়িতে হামলা করে। শুধু তাই নয়, তার বৃদ্ধ মাকে পর্যন্ত নিগৃত করা হয়। গ্রামের লোকজন ওই পুলিশ কনস্টেবলের বাড়িতে মানববিষ্ঠা ছুড়ে মারতেও দ্বিধা করেনি। এরপর সে বগুড়া শহরের এক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয় । চিকিৎসার পর সে এখন সুস্থ করোনা বিজয়ী এক পুলিশ কনস্টেবল।

দুটি ঘটনা থেকেই বুঝা যায়, গ্রামের লোক এখন আর আগের মত নেই। তারা তাদের সামাজিক দায়িত্ব ভুলে গেছে। রোগাক্রান্ত কোন ব্যক্তি অপরাধী নয়। সমাজের বোঝাও নয়। একজন স্বাস্থ্যকর্মী আরেকজন পুলিশ সদস্য। দুজনই করোনা যুদ্ধের অগ্রজ সৈনিক । মানব সেবা করতে গিয়ে তারা আক্রান্ত হয়েছে। তাদের প্রতি যারা অবহেলা করেছে তাদের প্রতি রইল চরম ঘৃণা। দেশে করোনা ভাইরাস এর সংক্রমণ শুরু হলে প্রথম দিকে দেশের মেধাবী চিকিৎসকদের ভূমিকা ছিল কিছুটা কাহাপুরুষোচিত।

কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে সেই চিকিৎসক সমাজও করোনা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। দেশের প্রায় চার শতাধিক ডাক্তার ও নার্স করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। ইতোমধ্যেই সিলেটের একজন ডাক্তার এই যুদ্ধে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। মানব সেবা করতে গিয়ে কয়েক শ” পুলিশ সদস্য আজ শরীরে করোনা ভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছে।

অসহায় মানুষের বাড়িতে পুলিশ সদস্যরা তাদের রেশনের চাল ডাল পৌঁছে দিয়ে এই মহাদুর্যোগে যে কর্তব্য পালন করে চলেছে, তাতে পুলিশের ইমেজ রাতারাতি পাল্টে গেছে । মানুষকে স্বাস্থ্য বিধি মানতে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে। সাতক্ষীরা জেলার প্রথম করোনা রোগী সুমনের বাড়িতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ইউ এন ও খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে গিয়ে মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি ।

এই মহা দুর্যোগে করোনা আক্রান্ত দুটি পরিবারের উপর নিষ্ঠুর আচরণে হতবাক হয়েছি । আপনারা যে যেখানে আছেন, প্রতেকেই যদি সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব পালন করে চলতে পারি তাহলে করোনা যুদ্ধে বাঙালি জাতিকে বিজয়ী হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র ।

লেখক : সম্পাদক,দৈনিক সংকল্প, RTV এর নিজস্ব প্রতিনিধি,সাতক্ষীরা।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন