নিউজ ডেস্ক:
অমর একুশে বইমেলা-২০২৬ শুরু হবে ২০২৫ সালে। ১৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত মেলা পরিচালনা করবে বাংলা একাডেমি। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে বইমেলা এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই বাস্তবতায় লেখক ও প্রকাশকরা পড়েছেন বেকায়দায়। এত কম সময়ের মধ্যে সৃজনশীল বইয়ের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও প্রকাশ করা দুরূহ হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন তারা। লেখক ও প্রকাশকরা জানান, এবার আর বইমেলা থাকছে না, বই বাণিজ্য মেলা হয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, একুশে বইমেলা ডিসেম্বরে আনার ঘোষণার দিন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচন ও রমজান উপলক্ষে প্রকাশকদের সঙ্গে পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত তিন মাস আগে পাণ্ডলিপি জমা নেন প্রকাশকরা। সেই হিসেবে নভেম্বরের মধ্যে লেখকরা পাণ্ডুলিপি রেডি করে জমা দেন। তবে এই হিসাব বিগত এক যুগেও ঠিক থাকেনি। বইমেলা চলাকালেও পাণ্ডুলিপি জমা নিয়ে বই প্রকাশ করার অনেক ঘটনা রয়েছে। কারণ লেখকরা লেখা শুরুই করেন দেরিতে। সৃজনশীল লেখার ক্ষেত্রে সব সময় সময়সীমা ঠিক থাকবে না। তাছাড়া অপেশাদার লেখক যারা সৃজনশীল বই লিখে সংসার পরিচালনা করেন না, তারা ছয় মাস আগে বা তিন মাস আগে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে প্রকাশকের কাছে জমা দেন না। ফলে মেলা চলাকালেও বই প্রকাশ করে উদ্বোধনের প্রচুর ঘটনা রয়েছে।
জানতে চাইলে আদর্শ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মাহাবুবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে তিন মাস আগে লেখকদের পান্ডুলিপি জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ লেখকই বই লিখে জীবন-জীবিকা চালান না। সেই বাস্তবতাও নেই বাংলাদেশে। যে কারণে মেলার আগে আগেই লেখা শুরু করেন। তাতে অনেক সময় নভেম্বর থেকে জানুয়ারিতে পাণ্ডলিপি জমা দেন। মেলার মধ্যেও পাণ্ডুলিপি আসে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে পাঠকের চেয়ে লেখক বেশি বলতে পারেন, প্রকাশকও বেশি। সে কারণে একটি বই ৩০০ কপি বিক্রি করা সম্ভব হয় না। এই ঘটনা প্রায় ৯০ শতাংশ। আমরা যতই লেখকদের তিন মাস আগে পাণ্ডুলিপি জমা দিতে বলি, তারা পরে জমা দেন। আর দেরিতে পাণ্ডুলিপি পাওয়ার কারণে বই ছাপতে আমরা দেরি করলে অন্য প্রকাশনা থেকে তা প্রকাশ করবে। সে কারণে আমরা যেমন চাপ দিতে পারি না, আবার সম্পর্কটাও নষ্ট হয়। এই বাস্তবতা অভ্যন্তরীণ। সে কারণেই মেলার মধ্যে পাণ্ডুলিপি আসে এবং আমরা ছাপতে বাধ্য হই। তাছাড়া সৃজনশীল কাজ সময় নির্ধারণ করে হয় না। অথচ এবার হুট করে সামনে তিন মাস সময় রেখে মেলা আয়োজন করা হচ্ছে। নির্বাচনের কারণে এগোনো হচ্ছে, রোজার কারণে তো নয়। আমরা আগে থেকেই জানি, মেলার মধ্যে রোজা পড়বে। এতে কোনও সমস্যা নেই।’
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির (বাপুস) সাবেক সহ-সভাপতি ও পুথিনিলয় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী শ্যামল পাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডিসেম্বরে বইমেলা করার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে। ফলে আমাদের প্রস্তুত থাকার কথা ছিল না। এখন প্রস্তুতি নিতে হবে। এ অবস্থায় ভালো মানের বই বা নতুন বই কম আসবে। লেখকরা সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বরে পাণ্ডুলিপি দেন। ফলে এবার পুরান বই বেশি থাকবে মেলায়।’
বাতিঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী দিপঙ্কর দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের সারা বছরের একটি প্রস্তুতি থাকে, সব প্রকাশনীর হয়তো থাকে না। আমাদের একটি ট্রেডিশন আছে— মেলার শেষ দিকে ৩০ শতাংশ লেখক পাণ্ডুলিপি দেন। এতে একটি সমস্যা হবে। ২০২৬ সালের মেলা শুরু হচ্ছে ২০২৫ সালে, সেটা এড়ানো যেতো। জানুয়ারির শুরুতে মেলা শুরু করে ১৫ বা ২০ দিন করলেই হতো। আমি সব সময় সংক্ষিপ্ত মেলার পক্ষে। আগে মানুষের সময় ছিল, এখন এত সময় নেই। তবে অনেক প্রকাশক এক মাসের মেলা পছন্দ করেন।’
নির্বাচনের পর মেলা করার সুযোগ থাকতো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পরের পরিস্থিতি ভালো থাকে না।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক লেখক ও কবি সৈয়ব জিবরান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই মেলার জন্য বই করবো না ঠিক করেছি। বইমেলা তো ব্যবসা না, এটা আমাদের ১৯৫২ সালের ঐতিহ্যের অংশ, সংস্কৃতির অংশ। এটা ব্যবসায়িক বইমেলা, এই মেলায় বই করার কোনও মানে হয় না। তাছাড়া এই সময়ের মধ্যে কোনও লেখক ভালো বই করতে পারবেন না। প্রবাসী সাহিত্যিকরা বইকে কেন্দ্র করেই আসেন। আমরা সাধারণত ডিসেম্বরে পাণ্ডুলিপি দেই। এভাবে হুট করে মেলা হবে ভাবিনি। বাস্তবতা হলো, এ মাসেই পাণ্ডুলিপি দিতে হবে। বইমেলায় যে ফ্লেভারটা পাই, তা এই বইমেলায় পাবো না। আগে ঢাকা বইমেলা হতো, এ কারণেই ঢাকা বইমেলা জমেনি। যারা বই কেনেন তারা উৎসবে থাকেন। এই বইমেলায় উৎসব কম থাকবে।’
কথাসাহিত্যিক ও ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালযয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমাদ মোস্তফা কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার পাণ্ডুলিপি ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। তবে সবার অবস্থা এক নয়, চাপ পড়বেই। আমি খুশি হতাম, নির্বাচনকে জানুয়ারিতে এনে বইমেলাটা যদি ফেব্রুয়ারিতে হতো। অমর একুশে বইমেলা নামের সঙ্গে একুশের সম্পর্ক আছে, সে জন্যই ফেব্রুয়ারিতে হলেই আমি সবচেয়ে খুশি হতাম। এখন আমরা দাবি জানালেই যে সেটা করবে তার নিশ্চয়তা নেই। এই বছর নির্বাচনের মধ্যে বইমেলা হওয়াটা ভালো না। বইমেলা বিশাল আয়োজন, নিরাপত্তার যে ইস্যু, বিশৃঙ্খলার একটি চেষ্টাও চলতে পারে। নির্বাচনের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ব্যস্ত থাকবেন। কিংবা তাদের মনোযোগ থাকবে সেদিকে। তাই এই বিশাল চাপ নেওয়া যায় না।’
তিনি বলেন, ‘রোজার মাসে বইমেলা আগেও হয়েছে, এটা হতে পারে। এমনকি এটাও হয়েছে নির্বাচন ও বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে হয়েছে। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়েছে, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়েছে, একইসঙ্গে বইমেলা হয়েছে। কিন্তু সেই সময়ের সঙ্গে এই সময়ের পার্থক্যটা হলো, এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যতটা দুর্বল, তখন এমন ছিল না। এখন আমরা সবকিছু নিয়েই চিন্তিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না। নির্বাচন যদি ফেব্রুয়ারিতে হয়, তাহলে সরকারের জন্য ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। কেন ডিসেম্বরে করা হচ্ছে, আমি জানি না। ঝুঁকি এড়াতে সরকার হয়তো ডিসেম্বরে করতে চাচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না, সে কারণেই হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
বিগত সময়ে একইসঙ্গে মেলা ও নির্বাচন হয়েছে। তাহলে এবার করা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগের বাস্তবতা আর এখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতা এক না। এখন রাজনৈতিক সংঘাত আরও বেশি। বর্তমান সময়ে আমি মনে করি, জানুয়ারি পারফেক্ট টাইম।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রকাশক ও লেখক জানান, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলা ২০২৫ সালে যে কারণেই শুরু করা হোক না কেন, অমর একুশের সঙ্গে এই মেলা সম্পর্কিত। এটি ডিসেম্বরে করার অর্থ হলো, বই বাণিজ্য মেলা করা। আমাদের ইহিতাস ঐতিহ্যের সঙ্গে বিষয়টি যায় না।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বইমেলা আমাদের আগ্রহের কারণে এগিয়ে আনা হয়নি। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির (বাপুস) লিখিত প্রস্তাবের ভিত্তিতে এগিয়ে আনা হয়েছে। বাপুস আমাকে কনফার্ম করেছে যে বিপুল সংখ্যক প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেহেতু স্টেট ম্যাকানিজম জানুয়ারিতে কিংবা ফেব্রুয়ারিতে করতে সম্মত নয়। প্রকাশকদের যদি আপত্তি থাকে তাহলে বাপুসের উচিত সেটা আমাদের জানানো এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পৌঁছানো। অথবা সংখ্যায় তারা অনেক বেশি হলে সবাই একত্রিত হয়ে এটা প্রদর্শন করা উচিত যে, এই সময় মেলা করা যাবে না। ধরা যাক, তারা স্মারকলিপি দেবে। মেলা ডিসেম্বরে করা তো আমাদের জন্যও সমস্যা। অনেক প্রোগ্রাম চেঞ্জ করতে বাধ্য হয়েছি।’
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির (বাপুস) সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন সেপ্টম্বর মাস। আরও এক সপ্তাহ আগে সিদ্ধান্ত হয়েছে। মেলা শুরু হবে ১৭ ডিসেম্বর। আড়াই থেকে তিন মাস সময় আছে। আর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ও রোজা। আমরা একবার চিন্তা করেছিলাম, নির্বাচনের পর করা যায় কিনা?’
বাংলা একাডেমিকে লিখিত দিয়ে ডিসেম্বরে মেলা অনুষ্ঠানের বিষয়ে রেজাউল করিম বাদশা বলেন, ‘আমরা তিনটি সময় মেলার কথা বলেছি— ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি পর (নির্বাচনের পর)। সবাই মিলে আলোচনা সপেক্ষে এই সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।’