জাতীয় ডেস্ক:
‘সে আমার সঙ্গে গাড়ি ধোয়। পরে আমি তাকে নিয়ে পুকুরে নামি। পানি যখন তার গলা সমান তখন মাথায় কয়েক কোষ পানি দেই। পরে তাকে পানিতে ডুবিয়ে ধরে রাখি। সে তখন বাঁচার জন্য আমার হাত খামচে ধরে। চারদিকে তাকিয়ে পুকুর থেকে ঘরে চলে আসি।’
ঘটনার চার দিন পর রোববার (২৫ জুন) দুপুরে ফেনীর দাগনভুঞার রাজাপুর ইউনিয়নের মধ্যম জয় নারায়ণপুর গ্রামে ঘটনাস্থলেই পুলিশ হেফাজতে নিজ শিশু কন্যাকে পুকুরে চুবিয়ে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন বাবা নিজেই।
মেয়েকে হত্যার পর প্রথমে নিখোঁজ, এরপর পুকুরে ডুবে মারা গেছে- এমন বিভ্রান্ত ছড়ালেও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যে সত্য ঘটনা সামনে উঠে আসে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাবার সামনেই তুলেন ধরেন তার দেখা পুরো ঘটনা। এ ঘটনায় গোটা এলাকাবাসীর মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। তারা ফাঁসির দাবিতে মিছিল করে বাবাকে ধিক্কার দিতে থাকে।
পাষণ্ড এই বাবার নাম টিপু (৩৫)। তিনি একজন ইজিবাইক চালক। তিনি ফেনীর দাগনভুঞার রাজাপুর ইউনিয়নের মধ্যম জয় নারায়ণপুর গ্রামে কবির আহাম্মেদের ছেলে।
আর নিহত জান্নাতুল আরিফা (৯) টিপুর প্রথম স্ত্রীর ঘরের সন্তান। আরিফা সিন্দুরপুর অদুদিয়া নুরানী মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত।
রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অপরাধীর মুখে নৃশংসতার গল্পের মিল খুঁজতে রাজাপুর ইউনিয়নের মধ্যম জয় নারায়াণপুর নিজ গ্রামে টিপুকে নিয়ে এসেছিল পুলিশ।
পুলিশ জানায়, গত ১০ বছর আগে নিহত জান্নাতুল আরিফার দেড় বছর বয়সে টিপুর সঙ্গে তার প্রথম স্ত্রী রোমানা আক্তারের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। টিপু দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার ঘরে দুই কন্যাকে নিয়ে মধ্যম জয় নারায়ণপুর গ্রামে নিজ বাড়িতেই থাকতো। আরিফা পাশের সিন্দুরপুর ইউনিয়নের চন্দ্রপুর গ্রামে নানার বাড়িতে মায়ের সঙ্গে থাকতো।
গত ৫/৬ বছর থেকে টিপুর প্রথম স্ত্রীর সন্তান আরিফাকে বছরে কয়েকবার ২/৩ দিনের জন্য দাদার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে আসতো। এর মধ্যেই আরিফার খোরপোষ ও সম্পত্তির দাবিতে একাধিক সালিশ বৈঠক ও মামলার কারণে টিপু ক্ষুব্ধ হয়। পরে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণ থেকে মুক্তি পেতে একপর্যায় সে নিজের কন্যাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, টিপু গত ১৩ জুন থেকে দফায় দফায় কাকুতি মিনতি করলে গত ১৮ জুন আরিফার নানা ওলি আহাম্মদ তার নাতিন আরিফাকে রাজাপুর বাজারে টিপুকে বুঝিয়ে দেন। ২০ জুন বিকেলে ৩টার দিকে টিপু আরিফার নানাকে মোবাইল ফোনে জানান আরিফা নিখোঁজ। এমন খবরে নানা ওলি আহাম্মেদ নাতিনের খোঁজে ছুটে আসেন টিপুর এলাকায়। একপর্যায় তিনি টিপুর সম্মতি না পেয়ে নিজেই আরিফার নিখোঁজের মাইকিং শুরু করেন। বিকেল ৫টার দিকে টিপু জানায়, পুকুর পাড়ে আরিফার স্যান্ডেল পাওয়া গেছে। এদিকে মাইকিংএ আরিফার নিখোঁজ সংবাদ শুনে একই এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী আরাফাত জানায়, টিপুই তার মেয়েকে পুকুরে ডুবিয়ে হত্যা করেছে। তার এই কথার ভিত্তিতেই পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয় আরিফার মরদেহ।
আরিফার মা রোমেনা আক্তার বলেন, টিপু নৃশংসতায় ভরা একজন মানুষ। সে বিচ্ছেদের আগে আমাকে অনেক শারীরিক নির্যাতন করেছে। তবে সে তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে তা কখনও আমার কল্পনাতেও আসেনি। আমি তার দ্রুত সময়ে ফাঁসি কার্যকর দেখতে চাই। তাকে ফাঁসি দেয়া না হলে বাবা জাতি কলঙ্কিত হবে।
তিনি আরও বলেন, আরিফার মৃত্যুর খবর শুনে টিপুর বাড়িতে গেলে সে আমাকে মারধর করে আমার কোল থেকে মেয়ের মরদেহ ছিনিয়ে নেয়। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।
টিপুর বাবা কবির আহাম্মদ বলেন, আমার নাতিন (আরিফা) নিস্পাপ। তাকে আমার ছেলে মেরেছে।আমি জানলে কখনই আমার নাতিনকে বাড়িতে আনতে দিতাম না। সে (টিপু) একটা পাষণ্ড। আমি তার বিচারে কঠিন শাস্তি চাই।
দাগনভুঞা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান ইমাম বলেন, পুলিশ ওইদিন পুকুর থেকে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছিল। পরে আরিফার মা ও নানার সন্দেহ এবং পুলিশের তদন্তে সত্য ঘটনা উঠে আসে।
পরবর্তীতে তাকে হত্যার দায়ে বাবা টিপুকে একমাত্র আসামি করে ফেনী দাগনভুঞা থানায় তার মা রোমেনা আক্তার একটি হত্যা মামলা করেন।
ফেনী সহকারী পুলিশ সুপার (সোনাগাজী ও দাগনভঞা সার্কেল) তাসলিম হোসেন বলেন, একদিকে দ্বিতীয় স্ত্রীর সংসার পরিচালনা করা ও অন্যদিকে প্রথম স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেয়া আরিফার ভরণপোষণ এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওনা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতেই মেয়েকে নৃশংস হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ছিল টিপু। তার বিচারে সর্বোচ্চ সাজা পেতে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আইনি সকল প্রক্রিয়া করা হচ্ছে।