জাতীয় ডেস্ক :
বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মঈনুল হাসান শোভন সদ্য বিয়ে করেছেন। শ্বশুরবাড়িতে করা প্রথম বাজারে তিনি রাজধানীর শান্তিনগর কাঁচাবাজার থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের একটি তাজা রুই মাছ কিনে নিয়ে যান। কিন্তু সমস্যা দেখা গেল রান্নার পর। মাছ থেকে একধরনের উৎকট গন্ধ আসছে এবং মাছের স্বাদও ভালো নয়। মঈনুল ভেবে পাচ্ছিলেন না, তাজা মাছের এমন দশা কী করে হয়।
রাজধানীর বাজারগুলো থেকে তাজা রুই, কাতল, পাবদা, কই, তেলাপিয়া ও পাঙাশের মতো মাছ কেনার পর রান্না করে দেখা যায় মাছগুলো থেকে একধরনের উৎকট গন্ধ আসছে। এ ছাড়া মাছের স্বাদও ভালো নয়। এ ক্ষেত্রে মানুষের মনে একটি প্রশ্ন প্রায়ই উঁকি দেয়, এসব মাছ কি শরীরের জন্য আদৌ ভালো? জীবিত মাছে রান্নার পর গন্ধ আসবে কেন? স্বাদও-বা এমন কেন?
মানুষের এসব সাধারণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সময় সংবাদের অনুসন্ধানী দল কাজ শুরু করে বেশ কয়েকটি মাছের খামার নিয়ে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, যেসব পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে এবং মাছকে যেসব খাবার খাওয়ানো হচ্ছে, তাতে মাছের বৃদ্ধি হচ্ছে বটে, তবে এর ‘ফুড ভ্যালু’ নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়।
ময়নসিংহের ত্রিশাল ও বরিশালের বাকেরগঞ্জের বেশ কয়েকটি মাছের খামার পরিদর্শন করে দেখা যায়, প্রায় খামারের ওপর কিংবা পাশেই রয়েছে মুরগির খামার। অধিক লাভের আশায় খামারিরা একসঙ্গে মাছ-মুরগি চাষ করে থাকেন। বরিশালের এক খামারি ইবনে ফয়সাল রিমন সময় সংবাদকে বলেন, ‘মাছের খামারের ওপর মাচা করে মুরগির খামার দিলে, মুরগির বিষ্ঠা দিয়েই মাছের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। এতে খাবারের খরচ কমে। এদিকে বাজারে মাছের খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ কমাতে এ পদ্ধতি বেশ কাজে আসে।’
মুরগির বিষ্ঠা খাইয়ে আদৌ মাছ চাষ করা যায় কি না, সে ব্যাপারে মৎস্য অধিদফতরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক আগে থেকেই মুরগির বিষ্ঠাকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে মাছ চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মূলত মুরগি পালনে নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যার অপাচ্য দ্রব্য মুরগির বিষ্ঠা হিসবে নিঃসৃত হয়। এটি মাছকে খাওয়ানো মানে বিষ খাওয়ানো ও সেই মাছ মানুষ খাওয়া মানে প্রত্যক্ষভাবে বিষ খাওয়া।
এ ধরনের খাবার খাওয়া মাছ মানুষ খেলে কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, সে ব্যাপারে সময় সংবাদের সঙ্গে কথা হয় বারডেম জেনারেল হাসপাতালের পুষ্টি কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধান শামসুন্নাহার নাহিদের।
তিনি বলেন, ‘আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, প্রতিটি প্রাণীর দৈহিক কার্যক্রম প্রায় একই ধরনের। মানুষের কথা চিন্তা করি, আমরা যে খাবার খাই তার অপাচ্য অংশটুকু মলমূত্ররূপে বের হয়ে আসে। এখানে থাকে নানা ধরনের নাইট্রোজেনঘটিত বিষাক্ত পদার্থ। মুরগির বেলায়ও কিন্তু তা-ই। এখন সে বিষাক্ত জিনিস যদি মাছ খেয়ে থাকে, তাহলে মাছের শরীরেও নানা ধরনের অসুবিধা দেখা দেবে। একইভাবে সেই মাছ মানুষ খেলে মানুষের পরিপাক সংক্রান্ত নানা রকমের জটিলতা দেখা দিতে পারে।’
মাছ থেকে কেন গন্ধ আসে ও স্বাদ কেন ভালো নয়–জানতে চাইলে শামসুন্নাহার বলেন, ‘নাইট্রোজেনঘটিত প্রতিটি বিষাক্ত পদার্থ থেকেই গন্ধ আসবে, এটাই স্বাভাবিক। একজন মানুষের কথাই ধরি, তিনি যদি পানি কম খান, কিংবা অনেকক্ষণ প্রসাব আটকে রাখেন, পরে মূত্রত্যাগের সময় তার প্রসাব থেকে বিশ্রী গন্ধ আসে। এটা হয় অতিরিক্ত নাইট্রোজেনের কারণে। মাছের বেলায়ও কিন্তু অনেকটা এমন। একটা মাছ যদি অনেক বেশি নাইট্রোজেনঘটিত পদার্থ খেয়ে ফেলে, তাহলে তার থেকেও একধরনের উৎকট গন্ধ আসবে।’
দীর্ঘদিন এ ধরনের মাছ খেলে যা যা সমস্যা হতে পারে সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি লম্বা সময় ধরে এ ধরনের মাছ খান, তাহলে আপনার পেটব্যাথা, ডায়রিয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের পরিপাকজনিত সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়াও পুকুর প্রস্তুতে যদি মাত্রাতিরিক্ত চুন, পটাশ কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, সেখান থেকেও পাওয়া মাছ খেলে মানবদেহে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে।’
মাছে ব্যবহৃত ওষুধের কথা বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওয়াহিদা হক বলেন, ‘বাংলাদেশে মাছের যেসব ওষুধ আসে, সেগুলো মূলত বিদেশ থেকে আসে। এগুলো কোন মাত্রায় ব্যবহার হবে তার নির্ধারিত কোনো স্ট্যান্ডার্ড কিন্তু সেভাবে ঠিক করা নেই। চাষিরা অনেক সময় মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য কিংবা চিকিৎসার জন্য হরমোন ব্যবহার করেন, এন্টিবায়োটিকও দেন।’
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে ওয়াহিদা হকের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়। যদিও মৎস্য অধিদফতর বলছে, তারা নিয়মিত মনিটরিং চালু রেখেছে, কিন্তু বেশির ভাগ খামারিই মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য খেয়ালখুশিমতো ওষুধ, হরমোন ও এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকে। এ ছাড়াও খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ডিলাররা প্যাকেটজাত মাছের খাবারে পচা শামুক, ঝিনুক ও নানা ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করে, যা বিষাক্ত। এ ছাড়াও মুরগির বিষ্ঠায় রয়েছে নানা ধরনের মাইক্রোসেল, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।