হোম আন্তর্জাতিক ভুটানের অর্থনৈতিক সংকট কতটা গুরুতর?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

বিদেশি ঋণের বোঝা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর রাজনৈতিক অস্থিরতা একটা দেশকে কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে নিতে যেতে পারে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ শ্রীলঙ্কা। দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটি দেউলিয়া হওয়ার পর আর কোন কোন দেশ একই পথে এগোচ্ছে, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। এর মধ্যেই এবার ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাঁচাতে বিশেষ যাত্রীবাহী যানবাহন, ভারী আর্থমুভিং মেশিন এবং কৃষি যন্ত্রপাতি ছাড়া বাকি সব ধরনের যানবাহন আমদানি নিষিদ্ধ করার কথা জানিয়েছে ভুটান। ফলে প্রশ্ন উঠছে, ভুটানও কি তাহলে শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে? দেশটির অর্থনৈতিক সংকট আসলে কতটা গুরুতর?

মোট দেশজ উৎপাদন বা গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্টের (জিডিপি) তুলনায় মোট জাতীয় সুখ বা গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস প্রচারের দর্শনের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত ভুটানও এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং দেশব্যাপী দীর্ঘদিন লকডাউন থাকায় ৮ লাখেরও কম জনসংখ্যার ল্যান্ডলকড (স্থল সীমান্ত বেষ্টিত) এ দেশটির সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। টিকে থাকার লড়াইয়ে আছে ভুটানের ছোট এবং মাঝারি আকারের ব্যবসাগুলো।

মূল্যবৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তায় উদ্বেগ

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সঙ্গীতা থাপলিয়াল বলেন, ‘ভুটানের পরিস্থিতি এখনই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করা যায় না।’

খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধের জন্য অর্থের অভাবের পর ঋণের বোঝায় ভেঙে পড়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি, যা জন্ম দেয় তীব্র বিক্ষোভের। ভুটানও বর্তমানে একই ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক সঙ্গীতা বলেন, ‘পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। কারণ এই যুদ্ধ পেট্রোলিয়ামের দাম বাড়িয়ে তুলেছে। ফলে অন্য অনেক দেশের মতো ভুটানের অর্থনীতিতেও মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, দিন দিন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির পতন ভুটানের মুদ্রা গুলট্রামের মান কমিয়েছে, যার কারণে বেড়েছে দেশটির আমদানি ব্যয়। ফলে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে বিদেশ থেকে আসা পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ভুটান।

ভুটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির কর্মকর্তারা বলছেন, গম রফতানিতে ভারতীয় নিষেধাজ্ঞা স্থানীয় বাজারে মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি উদ্বেগও বাড়িয়েছে। উদ্বেগ রয়েছে খাদ্য সরবরাহ নিয়েও।

যদিও নিজেদের জলবিদ্যুৎ এবং পর্যটন খাতের ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছে ভুটান। কারণ এই দুটি খাত থেকেই সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশটি। এছাড়া জিডিপির পরিপ্রেক্ষিতে ভুটানের উৎপাদন খাতের একটি অংশ স্থবির রয়েছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, যখন শিল্পখাত পরিচালিত হয়েছে প্রধানত নির্মাণ, খনি এবং বিদ্যুতের মাধ্যমে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ফ্রেমওয়ার্ক ভুটানের অর্থনৈতিক কাঠামোকে খাতভিত্তিক এবং বাহ্যিক সংকট মোকাবিলার জন্য দুর্বল করে তুলেছে। কারণ দেশটির জিডিপি, রফতানি এবং সরকারি রাজস্বের বেশিরভাগই মাত্র দুটি খাত থেকে আসে।

সম্প্রতি এক বৈঠকে ভুটানের অর্থমন্ত্রী লিয়নপো নামগয় শেরিং বলেন, সরকার আমদানি নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হবে।

ভুটান ‘অজানা গন্তব্যের’ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেরিং বলেন, ‘আমি বলতে পারি না যে আমাদের অর্থনৈতিক সংকটের কোনো হুমকি নেই। আমি বলতে পারি না যে আমরা কোনো সংকটের মধ্যে নেই। একই সঙ্গে আমি বলতে পারি না যে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি।’

রিজার্ভ কমে আসছে?

গেল জুলাইয়ে ভুটানের রয়্যাল মনিটারি অথরিটির দেয়া তথ্য বলছে, ২০২১ সালের এপ্রিলে ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে একই বছরের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৯৭০ মিলিয়ন ডলারে। এছাড়া করোনা মহামারির আগে দেশটির মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, যা বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে ভুটানের হাতে বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে ১৪ মাসের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। সংবিধান অনুযায়ী, ১২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে দেশটিতে।

ভুটানের জাতীয় সংবাদপত্র কুয়েনসেলের সিইও উগেন পেঞ্জরের মতে, আমদানি নির্ভর দেশ হওয়ায় অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ভুটানকে অন্যান্য খাতের দিকে নজর দিতে হবে এবং নীতিগুলো সংস্কার করতে হবে, যা রাজস্ব আনতে পারে। শুরুটা হতে পারে কৃষির জন্য নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ দিয়ে।

তিনি বলেন, আমরা এখনও ভয়ঙ্কর কোনো পরিস্থিতির মধ্যে নেই। তবে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। আপাতত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাঁচাতে বাণিজ্য ঘাটতির সমস্যা মোকাবিলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ভুটান।

পর্যটন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা

অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ভুটানিজ ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি পেমা তেনজিন বলেন, ‘পর্যটন খাত প্রভাবিত হয়েছে এবং অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। কিন্তু আমরা ঘুরে দাঁড়াব।’

ভুটানের রাজস্বের অন্যতম উৎস পর্যটন খাতে নিয়োজিত আছেন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে অন্য সব খাতের তুলনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই পর্যটন।

পর্যটন থেকে ভুটানে আগের বছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব কমেছে ৪১ শতাংশ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালে ভুটানে আসেন মাত্র ২৮ হাজার পর্যটক। যেখান থেকে আয় হয় ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ২০১৯ সালে ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫৯৯ জন পর্যটক ভুটান ভ্রমণ করেন, যেখান থেকে আয় হয়েছিল ২২৫ মিলিয়ন ডলার। রাজস্ব বাড়াতে তাই আগামী সেপ্টেম্বর থেকে আবারও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য সীমান্ত খুলে দেবে ভুটান, করোনা মহামারির কারণে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে যা বন্ধ ছিল।

যদিও দেশটিতে এবার ভ্রমণ খরচ বাড়ছে। টেকসই উন্নয়ন ফি বাবদ পর্যটকদের কাছে থেকে প্রতি রাতের জন্য নেয়া হবে ২০০ ডলার। গত তিন দশক ধরে এই ফি ছিল ৬৫ ডলার।

জলবিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন

ভুটানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার জলবিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত। দেশটি তার উৎপাদিত শক্তির প্রায় ৭০ শতাংশ ভারতে রফতানি করে। এছাড়া ভুটানের বৃহত্তম রফতানি বাজার, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারও ভারত।

তবে দীর্ঘায়িত অর্থনৈতিক সংকট ভারত ও ভুটানের মধ্যকার সম্পর্ককে তিক্ত করে তুলতে পারে, এমন শঙ্কাও রয়েছে। আর সেই সুযোগ নিতে পারে চীন। যদিও ভুটান এখন পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, আর চীনের সঙ্গে রয়েছে নিরপেক্ষ অবস্থানে।

বিশ্লেষক সঙ্গীতা থাপলিয়ালের মতে, ‘চলমান পরিস্থিতিতে ভুটানকে সাহায্য করা ভারতের জন্য অপরিহার্য। কারণ দুই দেশের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভারত ভুটানকে তার অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করলে দীর্ঘমেয়াদে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্তিশালী ও স্থিতিশীল থাকবে।’

সূত্র: ডয়েচে ভেলে

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন