জাতীয় ডেস্ক :
নাটোরে কলেজছাত্রকে বিয়ে করে আলোচনায় আসা শিক্ষিকা খাইরুন নাহারের লাশ উদ্ধারের পর বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কি ‘আত্মহত্যা’ করেছেন না-কি ‘হত্যার’ শিকার হয়েছেন। এমন প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে, ঘটনার পরপরই খবর পেয়ে শিক্ষিকার লাশ উদ্ধারের পাশাপাশি সেই কলেজছাত্র মামুনকে থানা হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে নাটোরের পুলিশ সুপার (এসপি) লিটন কুমার সাহা বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ভাইরাল হওয়া এই ছাত্র-শিক্ষিকার বিয়ে ও প্রেম কাহিনী যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তারা স্বামী-স্ত্রী এটিকে পজেটিভ হিসেবেই নিয়েছিল। পরবর্তীতে সামাজিক, পারিবারিক, কর্মক্ষেত্রসহ বিভিন্ন জায়গায় এই দম্পতির মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়। এছাড়াও ওই শিক্ষিকার আগের সংসারের সন্তানও চাপ সৃষ্টি করে। এসব চাপের কারণেই এটি ‘আত্মহত্যা’ কি-না, নাকি অন্য কোনও কারণ আছে আমরা তদন্ত করে দেখছি। এরপরই মূল রহস্য উদঘাটন হবে। তার স্বামীকে আমরা ঘটনাস্থল থেকেই হেফাজতে নিয়েছি এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মরদেহের সুরতহাল তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়াও এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’ বলে মনে হচ্ছে। যে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে তার দেহ ঝুলে ছিলো, সেটি আগুন গলিয়ে দিয়ে তার স্বামী মরদেহ নিচে নামিয়েছেন। ওই আগুনে সিলিং ফ্যানের প্লাস্টিকের কাভার পুড়ে গেছে। এসব ঘটনাও আমরা তদন্তের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করছি।
কোনও বিষয়ে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনমালিণ্য হয়েছে কি-না সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল শনিবার দিনগত রাত ২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত স্বামী মামুন বাসায় ছিলো এমন তথ্য পাওয়র ভিত্তিতে এসপি লিটন বলেন, যতো তথ্য আমরা পাচ্ছি সবগুলোই খতিয়ে দেখছি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলার পর স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা ঘটনার সম্ভব্য কারণ হিসেবে বলছেন, শোনা গেছে ছাত্রের সাথে শিক্ষিকার যে অসম বিয়ে, এটি একটি বৈধ সম্পর্ক। পরকীয়া বা অবৈধ সম্পর্ক নয়। তবুও, ওই শিক্ষিকার সহকর্মীরাসহ কেউই তার সাথে ভালো আচরণ করেনি। প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে তাকে। এমন পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। একইরকম বক্তব্য ওই শিক্ষিকার ভাই এবং ভাবীর বক্তব্যেও উঠে এসেছে। তারা বলেছেন, আত্মীয় স্বজনরাও সম্পর্কটিকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। সর্বক্ষেত্রে তাকে তিরস্কার করা হতো।
যেভাবে প্রেম ও বিয়ে:
ফেসবুকে পরিচয় ডিভোর্সি কলেজ শিক্ষিকা নাহারের সঙ্গে একই উপজেলার কলেজছাত্র মামুনের। প্রথমে দু’জনার বিষয়টি গোপন রেখেই এক বছর চলে এই অসম প্রেম। পরে দু’জনেই নিজেদের মধ্যে দূরত্ব ভুলে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। দু’জনের মতে বিয়ে করলেও গোপনেই চলতে থাকে তাদের পরিণয়। এক পর্যায়ে ৬ মাসের লুকোচুরি কাটিয়ে নাটোর শহরে বাসা নিয়ে সংসার করছিলেন ওই দম্পতি। আর তারপরই বিষয়টি জানাজানি হলে আলোচনা আর সমালোচনায় রূপ নেয় ৪৭ বছরের কলেজ শিক্ষিকা নাহারের সঙ্গে ২২ বছর বয়সী কলেজছাত্র মামুনের বিয়ে ও প্রেম কাহিনী। তবে বিয়েটি মামুনের পরিবার মেনে নিলেও মেনে নেয়নি নাহারের পরিবার। তাই এলাকা ছেড়ে এসে শহরে বাসা নিয়েছিলেন ওই দম্পতি।
প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই অনেকে এই সম্পর্ককে নেতিবাচক হিসেবে দেখছিলেন। এক সন্তানের জননী নাহারের আগের সংসার না টেকায় নেতিবাচক গল্প চাউর হয়ে উঠছিলো। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া সাক্ষাৎকারে প্রেমিক দম্পতি দাবি করেন, তারা সুখে আছেন। সারাজীবন এভাবেই জীবন পার করতে চান।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বরে গোপনে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন তারা। বিয়ের ৬ মাস পর তারা নাটোর শহরে একই বাসায় বসবাস করায় তা প্রথমে বন্ধু মহলে ও পরে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে জানাজানি হলে কলেজছাত্র মামুনের পরিবার বিয়েটি মেনে নিলেও শিক্ষিকা নাহারের পরিবার মেনে নেয়নি। শিক্ষিকা মোছা. খাইরুন নাহার গুরুদাসপুরের খুবজিপুর এম হক ডিগ্রি কলেজের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও গুরুদাসপুরের খামার নাচকৈড় এলাকার বাসিন্দা। আর কলেজছাত্র মামুন হোসেন নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কলেজ শিক্ষিকা নাহার প্রথমে বিয়ে করেছিলেন রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার এক ছেলেকে। পারিবারিক কলহে সেই সংসার বেশিদিন না টিকলেও সেই স্বামীর ঘরে ২টি সন্তান রয়েছে।
ঘটনার জানাজানির পর কলেজছাত্রকে বিয়ের বিষয়ে খাইরুন নাহার বলেছিলেন, ‘প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। সেই সময় ফেসবুকে মামুনের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর দু’জনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে ভালোবাসা হয়। তারপর দু’জন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করি। সমাজে কে কী বললো তা বড় বিষয় না। যদি দু’জন ঠিক থাকি, তাহলে সব ঠিক। আমার পরিবার থেকে সম্পর্ক মেনে নেয়নি। মামুনের বাড়ি থেকে মেনে নিয়েছে। আমার শ্বশুর-শাশুড়িও আমাকে অনেক ভালোবাসে। অনেক সুখে আছি।’
ওই সময়ে স্বামী মামুন বলেছিলেন, ‘খাইরুনকে বিয়ে করে আমি খুশি এবং সুখী। সবার দোয়ায় সারাজীবন এভাবেই থাকতে চাই।’
ওই সময়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কলেজ শিক্ষিকা একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘চাকরিজীবী স্বামী বাহিরে থাকায় কিছুটা বেপরোয়া জীবনযাপনের কারণে স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে নাহারের। তারই জেরে সংসার ভাঙে তাদের। এরইমধ্যে মামুনের সঙ্গে পরিচয় ও প্রণয় হলে সে আশ্রয় হিসেবে সম্পর্কটাকে স্থায়ী করতে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ভাইরালও হয়েছে। এতে কেউ পক্ষে দোয়া আশীর্বাদ কামনা করে বাহবা দিয়েছেন আবার অনেকে কতোদিন টিকবে তাদের সংসার তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।’
ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর খুবজীপুর মোজাম্মেল হক ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু সাইদ বলেছিলেন, ‘খায়রুন নাহার আমার প্রতিষ্ঠানের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ফেসবুকের এই খবর দেখে প্রথমে ঘটনা জানলাম। ওই শিক্ষিকা বছরখানেক আগে বলেছিলেন, তিনি নাটোর শহরে বাসা নিবেন। এতটুকুই জানতাম।’