বাণিজ্য ডেস্ক :
মায়ের চিকিৎসার জন্য দ্রুত ভারত যেতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র দীপুর। কিন্তু ডলার কিনতে গিয়ে ব্যাংক-খোলাবাজার কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো বলছে, আপাতত তারা নগদ ডলার বিক্রি বন্ধ রেখেছে। খোলাবাজারে কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জে ডলার পাওয়া গেলেও, তারা দাম হাঁকাচ্ছে ১১৬ থেকে ১১৮ টাকা। মাত্র কয়েক মাসের মাথায় টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেধে দেয়া রেট অনুযায়ী বর্তমানে আন্তঃব্যাংকে ডলার লেনদেন ৯৫ টাকায় হলেও, সে সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
সরেজমিনে মতিঝিলের কয়েকটি ব্যাংকে ডলার কিনতে গেলে জানানো হয়, বর্তমানে নগদ ডলার বিক্রি বন্ধ রয়েছে। এ ব্যাপারে দিলকুশার জনতা ব্যাংকের সামনে কথা হয় হাসিবুল আলমের সঙ্গে।
সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ‘ডলার কিনতে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে গিয়েছিলাম। সবখানেই এক কথা- নগদ ডলার বিক্রি বন্ধ। ব্যাংকগুলো বলছে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের কথা। কিন্তু সবার হাতে তো ক্রেডিট কার্ড নেই। ব্যাংকে ডলার না পেয়ে আশপাশের কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জে গেলে তারাও জানায় ডলার নেই। যাদের হাতে ডলার আছে, তারা অযৌক্তিক দাম হাঁকছেন।’
ব্যাংকগুলোতে কেন ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না- এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি এক ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা সময় সংবাদকে বলেন, ‘মূলত ব্যবসায়ীদের জন্য আমরা হাতে ডলার রাখছি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও আমরা পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছি না। ডলারের জন্য অন্য ব্যাংকগুলোর দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। অন্য ব্যাংক থেকে নিজেদের মধ্যে কেনাকাটায় ও রেমিট্যান্সের ওপরে ভর করে ডলার মজুত করে রাখতে হচ্ছে আমাদের। এখন গণহারে ডলার বিক্রি করলে কদিনের মধ্যে কোষাগার খালি হয়ে যাবে।’
মতিঝিল থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত রয়েছে অসংখ্য মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি। স্বাভাবিক সময়ে ব্যাংকে ডলার না পেলে কিংবা কাগুজে ঝামেলা এড়াতে মানি এক্সচেঞ্জারদের দ্বারস্থ হন ক্রেতারা। কিন্তু এবার মানি এক্সচেঞ্জারেও পাওয়া যাচ্ছে না ডলার। মানি এক্সচেঞ্জারে কেন ডলার নেই জানতে চাইলে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক মুদ্রা ব্যবসায়ী জানান, ‘এখন ডলার মজুত করলেই লাভ। মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ছিল ১১৪-১১৫ টাকা। বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) ১২০ টাকা দিয়েও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। আরও দাম বাড়লে ব্যবসায়ীরা দ্বিগুণ লাভে ডলার বিক্রি করতে পারবে এ আশায় ডলার মজুত করে রাখছেন।’
বায়তুল মোকাররম মার্কেটের আরেক মানি এক্সচেঞ্জার ব্যবসায়ী রাহাত বলেন, ‘বুধবার (১০ আগস্ট) সকালে ডলার বিক্রি হয়েছে ১১৫ টাকা দরে। একই দিন বিকেলে এসে ডলারের দাম ৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ১২০ টাকা। ডলারের দশা হয়েছে শেয়ারমার্কেটের মতো। দাম নিয়ে আপনি আগে থেকে কিছু বলতে পারবেন না। তবে ধারণা করা যাচ্ছে, ডলারের দাম আরও বাড়বে। কদিনের মধ্যে প্রতি ডলারের দাম দাঁড়াতে পারে ১২৫ টাকা। বেশি লাভের আশায় যাদের হাতে ডলার আছে, তারা আর বিক্রি করছেন না।
এছাড়াও মতিঝিল এলাকার বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জের সামনে দেখা গেছে দালালদের আনাগোনা। ডলার বিক্রি কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী এক দালাল চক্র।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, পল্টনে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটের উল্টো পাশে রয়েছে সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেট। বাজারে ডলার সংকট হলেও তাদের কাছে নেই সংকট। নগদ টাকা পেলেই হাজির করা হয় বৈদেশিক মুদ্রা। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ডলারের ব্যবসা করছেন তারা।
কেবল মানি এক্সচেঞ্জার নয়, ডলার নিয়ে কারসাজিতে জড়িত খোদ ব্যাংক খাত। চলতি মাসেই বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা বেশি মুনাফার লোভে প্রয়োজনের বেশি ডলার সংরক্ষণ করেছে। এরইমধ্যে ডলার মজুতের অভিযোগে সোমবার (৮ আগস্ট) ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ডাচ্ বাংলা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কেবল ডলার কেনাবেচা করে গত মে মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে এসব ব্যাংক।
এদিকে খোলাবাজারে ডলারের অরাজকতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমগুলোকে বলেন, ‘যারা খোলাবাজারে ডলারের অবৈধ ব্যবসা করছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এ পর্যন্ত পাঁচটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি ৪২টিকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। শোকজের যথাযথ উত্তর দিতে পারলে এসব মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্সের বিষয়ে বিবেচনা করা হবে। অভিযানে আরও ৯টি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স না নিয়ে এতদিন ব্যবসা করে আসছিল।’
বাজারে ডলারের এমন দুর্দশা নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সময় সংবাদকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল ডলারের দর এক জায়গায় আটকে না রাখা। ধীরে ধীরে টাকার অবমূল্যায়ন হতে দিলে এখন এসে একবারে ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়নের ধাক্কা সামলাতে হতো না। এখানে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের অভাব রয়েছে। ডলারের দর আটকে রাখা ব্যাংকের একটি ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করি আমি।’
ডলারের বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায়। এ সময় মুদ্রাবাজার অনেকটা স্থিতিশীল থাকলেও ২০২১ এ এসে বেড়ে যায় আমদানি ব্যয়। ২০২১ সালের ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো এক ডলার ৮৫ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এরপর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ৮৬ টাকা, গত ২৭ এপ্রিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা, গত ১০ মে ৮৬ ডাকা ৫০ পয়সা এবং সবশেষ গত ২৫ জুলাই প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।
চলতি মাসের শুরু থেকেই বাজারে দেখা দিয়েছে ডলার সংকট। বুধবার (১০ আগস্ট) ডলারের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে সংকট রূপ নেয় চরমে। এদিন ডলার বিক্রি হয় ১১৯-১২০ টাকা দরে। বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) সকালে বেশিরভাগ মানি এক্সচেঞ্জে ডলার কিনতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয় অনেক সাধারণ ক্রেতাকে। বিকেলের দিকে ডলারের দাম কিছুটা কমলেও, কমেনি ডলার সংকট। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে ডলার কেনার পরিবর্তে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে জোর দেয়ার কথা বলছে, তবে সাধারণ মানুষের বক্তব্য- অনেকের হাতেই ক্রেডিট কার্ড নেই, আর নগদ ডলার ব্যবহার কার্ডের চেয়ে বেশি সুবিধাজনক বলে জানান তারা।