বিনোদন ডেস্ক:
ভারতীয় সিনেমায় নাচ-গান কেবলমাত্র বিনোদনের উপকরণ নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়। এই পরিচয়কে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কোরিওগ্রাফার সরোজ খান। ৯০ দশকের জনপ্রিয় ‘এক দো তিন’, ‘চোলি কে পিছে’, ‘নিম্বুডা নিম্বুডা’ বা আরও অনেক হিট গানের নৃত্যপরিচালক হিসেবে তিনি ভারতীয় নাচকে দর্শকের অনুভবের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আলোচিত গান নিঃসন্দেহে সঞ্জয় লীলা বানসালির ‘দেবদাস’-এর ‘দোলা রে দোলা’। যে গানটি তাকে এনে দেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ ১৭টি সম্মাননা।
২০০২ সালের ‘দেবদাস’ ছিল একটি উচ্চাভিলাষী ও ব্যয়বহুল প্রজেক্ট। প্রায় ৫০ কোটি রুপি বাজেটের এই চলচ্চিত্রে সঞ্জয় লীলা বানসালি প্রতিটি দৃশ্যে নিখুঁত সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আর সেই নিখুঁততার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল গান ‘দোলা রে দোলা’। যেখানে একই গানে মুখোমুখি নাচবেন বলিউডের দুই সেরা নৃত্যশিল্পী–অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিত ও ঐশ্বরিয়া রাই। দর্শক জানতেন যে, এই গানেই ঘটবে দুই প্রজন্মের নৃত্যশৈলীর বাস্তব ‘ড্যান্স–অফ’। তাই গানটির কোরিওগ্রাফি হয়ে উঠেছিল নির্মাতাদের জন্য একটি বিরাট দায়িত্ব এবং সরোজ খানের জন্য জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ।
নিজেই সরোজ বলেছিলেন, এটি তার ক্যারিয়ারের ‘সবচেয়ে কঠিন গান’। তিনি জানতেন দুই অভিনেত্রীই অসাধারণ নৃত্যশিল্পী এবং কাউকে যেন মনে না হয়, তাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে—এই ভারসাম্য রক্ষা ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেছিলেন, ‘মাধুরী দীক্ষিত নিজের মতো রিহার্সাল করে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে সেটে আসতেন, অন্যদিকে ঐশ্বরিয়া রাই সেটেই দীর্ঘ সময় ধরে অনুশীলন করতে পছন্দ করতেন। এই ভিন্ন প্রস্তুতি, ভিন্ন অভ্যাস, দুই তারকার সমান গুরুত্ব—সব মিলিয়ে গানটি ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি নির্মাণপর্ব।’
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো—গানটির শুটিংয়ের সময় সরোজ খান ভয়াবহ অসুস্থ ছিলেন। সঞ্জয় লীলা বানসালি পরে জানিয়েছিলেন, ‘সরোজ খান এতটাই ব্যথায় কাতর ছিলেন যে দাঁড়িয়ে কাজ করাও সম্ভব ছিল না। তিনি মেঝেতে শুয়ে স্টেপ বুঝিয়ে দিতেন, নির্দেশনা দিতেন এবং সেই অবস্থাতেই টানা ১৫ দিন কাজ করেন। তার কষ্ট, দুর্বলতা বা শারীরিক সীমাবদ্ধতার কোনও ছাপ কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও পর্দায় দেখা যায় না। বরং পর্দায় যা দেখা গিয়েছিল, তা ছিল নিখুঁতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ, সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যের সমন্বিত এক চিরস্মরণীয় নৃত্য–প্রদর্শনী।’
‘দেবদাস’ মুক্তির দিন সরোজ খান হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বানসালি ও ঐশ্বরিয়া তাকে দেখতে গেলে আধা-জ্ঞান অবস্থায়ও সরোজ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘দোলা রে দোলা-তে লোকজন কয়েন ছুঁড়ল তো?’
বলিউডের ঐ পুরনো অভ্যাস—হিট গানের ওপর দর্শকের কয়েন ছোড়া—তিনি জানতে চেয়েছিলেন তার গান সেই ভালোবাসা পেয়েছে কি না। এই প্রশ্নই বলে দেয় কাজের প্রতি তার নিবেদন ঠিক কতটা গভীর ছিল।
সরোজ খান ভারতীয় চলচ্চিত্রের কোরিওগ্রাফির ধারণাকেই পাল্টে দিয়েছিলেন। বানসালি পরে মন্তব্য করেছিলেন, ‘যেমন সেলিম–জাভেদ চিত্রনাট্যকে তারকা মর্যাদা দিয়েছিলেন, সরোজ খান কোরিওগ্রাফিকে সেই মর্যাদা এনে দিয়েছিলেন। তার আগে বড় কোরিওগ্রাফার অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু সরোজ খান এই পেশাকে যেভাবে আলোয় এনেছিলেন, তা অনন্য।’
‘দোলা রে দোলা’ শুধু ঐশ্বরিয়া রাই ও মাধুরী দীক্ষিতের পর্দায় কালজয়ী নাচ নয়—এটি সরোজ খানের শিল্পসত্তার সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অসুস্থ শরীর, সীমাহীন পরিশ্রম ও অদম্য আবেগ দিয়ে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন এমন এক সৃষ্টি, যা আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে অমলিন। তার মৃত্যুর পরও এই গানই প্রমাণ করে, ভারতীয় নৃত্যরচনার ইতিহাসে সরোজ খান এক অমর নাম। যে গানটি দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির এক অবিস্মরণীয় উদাহরণ হিসেবে।
১৯৪৮ সালের এই দিনে (২২ নভেম্বর) মুম্বাইয়ে জন্ম নেওয়া সরোজ খান না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ২০২০ সালের ৩ জুলাই।
সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
