হোম জাতীয় বাংলাদেশের জেন জি বিপ্লব কি ব্যর্থ হচ্ছে?

বাংলাদেশের জেন জি বিপ্লব কি ব্যর্থ হচ্ছে?

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 91 ভিউজ

নিউজ ডেস্ক:
অন্ধকারে আট বছরের নির্বাসন। যেখানে দিনের আলো বা বাতাসের কোনো প্রবাহ নেই। একজন বন্দীকে বসতে হয় তেলাপোকা, ইঁদুর ও মশার সঙ্গে। দিন-রাতের পার্থক্য বোঝা যায় না। একমাত্র কামনা থাকে—মৃত্যু। এভাবেই হতাশার কথাগুলো জানাচ্ছিলেন গুম হওয়া মীর আহমদ বিন কাসেম (আরমান), যিনি বলেন, ‘সেখানে আমার কিছু করার ছিল না, প্রতিটি রাতে কারারক্ষীদের আসার অপেক্ষায় থাকতাম, তারা এসে আমাকে নিয়ে যাবে বলে।’

আরমান জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে। ২০১৬ সালে গুম হওয়ার আগে তিনি পতিত স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার লক্ষ্যবস্তু হওয়া তার পিতার আইনজীবী হিসেবে কাজ করছিলেন। সেই সময় বিশেষ কারাগারে বন্দী করা হতো বহু মানুষকে। কারাগারের নাম ছিল ‘আয়নাঘর’। সেখানে বন্দীদের হাত ও চোখ বেঁধে রাখা হতো। কয়েকশত বন্দীর মধ্যে আরমানও ছিলেন। তিনি গত বছরের ৬ আগস্ট এই ভয়ঙ্কর বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান। আরমান বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আমাকে মেরে ফেলা হবে। আমি দোয়া কালাম পড়ছিলাম। তবে আমাকে উন্মুক্ত একটি মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়।’

মুক্তির ঠিক মাস খানেক আগে বাংলাদেশে ঘটে এক নজিরবিহীন ইতিহাস। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন, যা পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এটিকে ‘বর্ষা বিপ্লব’ বা ‘মুনসুন রেভ্যুলেশন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ওই অভ্যুত্থানে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা নেত্রী শেখ হাসিনা পতিত হন এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারত। আরমান যখন মুক্তি পান, তখন এই খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, আমরা ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছি।’

হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাত্র নেতারা নতুন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করেন। তারা বাংলাদেশের পরবর্তী নেতার দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। এই সরকার শপথ নেয় ক্ষমতার অতিপ্রভাবের রাজনীতি শেষ করে সামাজিক, বিচারিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিতে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে ঘটে যাওয়া গুম, হত্যাকাণ্ড ও কোটি কোটি টাকা পাচারের পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয় তারা। তবে ত্রয়োদশ নির্বাচনের দিকে এগোতে গিয়ে দেশ ১৭ কোটি নাগরিকের জন্য ঐক্য রক্ষার সংগ্রাম করছেন ড. ইউনূস।

একই সময়ে ছাত্রনেতাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাচীন পরিবারতান্ত্রিক প্রভাব আবার সক্রিয় হচ্ছে। সমাজে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কট্টর ইসলামপন্থীদের উত্থানের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এদিকে আওয়ামী লীগ দাবি করছে তাদের কিছু নেতা-কর্মী হত্যা করা হয়েছে। ড. ইউনূসের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও ওঠেছে। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা ড. ইউনূসের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক কারণে গণঅভ্যুত্থানকে কিছু মানুষ মিথ্যা ভোর হিসেবে মনে করতে শুরু করেছেন। ঢাকার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনির বলেন, ‘আমাদের জাতীয় ঐক্যের একটি বিরল মুহূর্ত ছিল, যা এখন পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। আমরা বিভক্ত, একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছি।’

তবে জনগণের মনে হাসিনার প্রতি প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা এখনও জ্বলজ্বল করছে। তার ফাঁসির দাবি নিয়ে রাজধানীর রাস্তাগুলো ভরে আছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ভয়াবহ গণহত্যার জন্য হাসিনাকে দায়ী করা হচ্ছে। ব্যানারে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, অভ্যুত্থানে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে কয়েক ডজন শিশু। অধিকাংশ নিহত হয়েছেন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজগুলোর মধ্যে ছিল এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে নতুন প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘‘গণহত্যার নির্দেশ, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, উস্কানি ও সহায়তার জন্য ৭৮ বছর বয়সী হাসিনার মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে।’’ তিনি বলেন, ‘এগুলো সবচেয়ে গুরুতর ও জঘন্যতম অপরাধ।’ প্রধান প্রসিকিউটর আরও জানান, ঢাকা ভারতের কাছে প্রত্যর্পণের অনুরোধ করেছে, কিন্তু নয়াদিল্লি কোনো আনুষ্ঠানিক সাড়া দেয়নি। কর্মকর্তারা মনে করেন, হাসিনাকে ফেরত আনার সম্ভাবনা কম, কারণ ভারতের প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী অপরাধ রাজনৈতিক হলে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রয়েছে।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পিতা মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। তার ৮০ বছর বয়সী মা খালেদা জিয়া কয়েক দশক বিএনপির দায়িত্বে ছিলেন এবং পরে তা ছেলের কাছে হস্তান্তর করেছেন।

ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে নতুন দল, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তিনি মনে করেন দেশের রাজনীতিতে স্বাভাবিক ধারা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। নাহিদের মতে, গত বছরের গণঅভ্যুত্থান ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ধারা, দুর্নীতি ও জনগণকে উপেক্ষা করা রাজনীতির বিরুদ্ধে ছিল। মানুষ যখন রাস্তায় নেমেছিল, তারা শুধু সরকার উৎখাত চায়নি, বরং পুরনো রাজনীতি বিলোপের মাধ্যমে আইনের শাসন, ন্যায্যতা, জবাবদিহিতা ও মর্যাদা দাবি করেছিল। তবে তার ধারণা, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু নাও হতে পারে।

একই সময়ে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক, তাকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং ভারতের সঙ্গে চলমান টানাপোড়েনের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে।
সূএ-দৈনিক ইত্তেফাক

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন