আব্দুল্লাহ আল মামুন:
মোঃ আমিরুল ইসলাম, একজন সাধারণ গলদা চাষি। কয়েক বছর আগেও তাঁর জীবনে ছিল শুধু হতাশা। ঘেরে চিংড়ি মজুদ করতেন, কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই রোগে মারা যেত। একসময় তিনি ভেবেছিলেন, ভাইরাসই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। প্রতিবার চাষে লোকসান গুনে পরিবার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছিল। স্ত্রী-সন্তানের মুখে হাসি নয়, বরং অনিশ্চয়তার কালো ছায়াই ছিল নিত্যসঙ্গী। ঠিক তখনই আশার আলো হয়ে আসে মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট (SCMFP)। অফিসের বিশেষজ্ঞরা তাঁর ঘের পরিদর্শন করে জানান সমস্যা ভাইরাস নয়, বরং ঘেরের অগভীর পানি ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম, নতুন যাত্রা, পরিবর্তনের যাত্রা।
পরে তিনি মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট (SCMFP) এর আওতায় ঘের উন্নয়ন ও আধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ে পরামর্শ পান। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি—
• ঘের খনন করে পানির গভীরতা ৫ ফুটে উন্নীত করেন,
• চারপাশের পাড় সংস্কার করে নিয়ম অনুযায়ী বাঁধ নির্মাণ করেন,
• চারপাশে ব্লু নেট স্থাপন করে বায়োসিকিউরিটি নিশ্চিত করেন,
• পানির গুণগত মান উন্নত রাখার সকল ব্যবস্থা করেন।
এছাড়া তিনি অংশ নেন নানা প্রশিক্ষণে যার মধ্যে চিংড়ি চাষের মৌলিক প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, ঘের ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রস্তুতকরন প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক বাজার বিষয়ে জ্ঞান, হাতে-কলমে চাষ ব্যবস্থাপনা ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার বিষয়ক উচ্চতর প্রশিক্ষণ উল্লেখযোগ্য।
ক্লাস্টার গঠনের আগে তিনি পারতেন না—
• ঘেরের গভীরতা ও পাড় নিয়মিত সংস্কার
• চুন প্রয়োগ ও পানির গুণগত মান পরীক্ষা
• জৈবনিরাপত্তা (নীল নেট, ফুট বাথ)
• ভাইরাসমুক্ত পোনা ও পিএল নির্বাচন
• মানসম্মত খাদ্য ব্যবহার
• প্রোবায়োটিক, প্রিবায়োটিক, মিনারেলস প্রয়োগ
• খাদ্য প্রয়োগ চার্ট ও গ্রোথ চার্ট অনুসরণ
• ব্যবসায়িক পরিকল্পনা
• দলবদ্ধভাবে কাজ করার মানসিকতা
কিন্তু ক্লাস্টারে যুক্ত হওয়ার পর এখন তিনি পারেন—
• ঘেরের গভীরতা বাড়ানো, পাড় ও স্লোপ নিয়ম মেনে রক্ষণাবেক্ষণ
• মাটি ও পানির গুণাগুণ পরীক্ষার পর চুন প্রয়োগ
• রিচিংয়ের মাধ্যমে পানি জীবাণুমুক্ত করা
• ঘেরে নীল নেট ও ফুট বাথ ব্যবহার করে জৈবনিরাপত্তা বজায় রাখা
• ভাইরাসমুক্ত এসপিএফ পোস্ট-লার্ভা (PL) একবারেই মজুদ করা
• মানসম্মত খাদ্য ব্যবহার ও নিয়ম মেনে প্রয়োগ
• প্রোবায়োটিক, প্রিবায়োটিক ও মিনারেলস নিয়মিত ব্যবহার
• খাদ্য প্রয়োগ চার্ট ও গ্রোথ চার্ট অনুসরণ
• ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন
• ২৫ জন চাষির সাথে দলবদ্ধভাবে কাজ করে সফল হওয়া
মৎস্য দপ্তরের অনুদান ও সহায়তা চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য মৎস্য দপ্তর তাঁকে মোট ২,১৪,৬৭৮ টাকা অনুদান প্রদান করে। এই অর্থের মাধ্যমে, দপ্তরের তত্ত্বাবধানে, তিনি ঘেরের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ সংগ্রহ করেন খাবার (Feed): ৯৬০ কেজি, চুন (Lime): ২৪০ কেজি, ব্লিচিং: ২৪০ কেজি, মোলাসেস: ৪৮ কেজি, অটো পালিশ: ৬০ কেজি, ইস্ট: ২৪০ গ্রাম, প্রোবায়োটিকস: ২.৪ কেজি, চিংড়ি পোস্ট-লার্ভা (PL): ২১,৬০০ টি। মৎস্য দপ্তরের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে আমিরুল ইসলামের ঘের ব্যবস্থাপনায় আসে বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন। আগে যেখানে ঘেরে পানি পরীক্ষা, মানসম্মত খাদ্য ব্যবহার, জৈবনিরাপত্তা এসব কিছুই উপেক্ষিত ছিল, সেখানে এখন তিনি প্রতিটি ধাপ নিয়ম মেনে করছেন। তিনি নিজে মাটি ও পানির সকল পরীক্ষা করতে পারেন। মৎস্য দপ্তরে পিসিআর মেশিন থাকায় প্রয়োজনে পিএল রোগমুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করতে পারেন। চাষের শুরু থেকে শেষ সকল তথ্য রেকর্ড বুকে লিখে রাখেন। নিরাপদ মাছ উৎপাদনের জন্য ঘেরে ব্যবহার করেন না কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চিংড়ি চাষে নানা ঝুঁকি যেমন পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি, লবণাক্ততার পরিবর্তন ও হঠাৎ বৃষ্টিপাতের কারণে উৎপাদন হ্রাস পেত। কিন্তু ক্লাস্টার পদ্ধতিতে একসাথে কাজ করার ফলে চাষিদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সহজ হয়েছে। বিশেষ করে ঘেরে পানির গভীরতা বৃদ্ধি করার কারণে তাপমাত্রার তারতম্য সহজে প্রভাব ফেলতে পারে না, পানির মান স্থিতিশীল থাকে এবং রোগের ঝুঁকিও অনেক কমে গেছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় ক্লাস্টার পদ্ধতি ও গভীর ঘের দুটোই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে আয় বৃদ্ধির ফলে আমিরুল এখন তার ছেলে-মেয়েদের ভালো জামা-কাপড় কিনে দিতে পারেন, প্রয়োজনীয় শিক্ষার খরচ চালাতে পারেন, পরিবারের জন্য উন্নত চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন। এমনকি তিনি জমিও ক্রয় করেছেন। আগে যেখানে সংসারে অনিশ্চয়তা ছিল, এখন সেখানে এসেছে নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য।
বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ও সঠিক ইনপুট ব্যবহারের ফলে এবার তার ঘের হয়ে ওঠে লাভজনক। যেখানে আগে উৎপাদন ছিল মাত্র ১.৮ কেজি/শতাংশ, সেখানে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.২ কেজি/শতাংশ।
এক মৌসুমে তিনি উৎপাদন করেছেন ৬২৫ কেজি চিংড়ি, যা বিক্রি করে আয় হয়েছে ৯,০৬,২৫০ টাকা। অর্থাৎ আগে তিনি প্রতি বছর লোকসান করতেন, এখন তিনি শুধু লাভবানই নন, আশেপাশের শত শত চাষির জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। তিনি আবেগভরা কণ্ঠে বলেন“চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমার জীবনমান উন্নয়নের জন্য মৎস্য অফিস যা করেছে, তা নিজের বাবা-মা কিংবা আত্মীয়-স্বজনও করে না।”
যে আমিরুল একসময় ক্ষতির ভয়ে দিশেহারা ছিলেন, আজ তিনি আশেপাশের চাষিদের কাছে রোল মডেল। তার সাফল্যের গল্প শুনে আরও অনেক চাষি ঘের উন্নয়ন ও বিজ্ঞানভিত্তিক চাষে এগিয়ে আসছেন। মৎস্য অফিসের সময়োপযোগী অনুদান, আধুনিক প্রযুক্তি এবং আমিরুল ইসলামের দৃঢ় মনোবল মিলেই তাঁর এ সফলতা। আগে যেখানে আমিরুল ইসলাম প্রতিবছর লোকসানের শিকার হতেন, এবার মৎস্য অধিদপ্তরের অনুদান, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তির কারণে তিনি এক মৌসুমেই প্রায় ৯ লাখ টাকা নিট লাভ অর্জন করেছেন। এখন তাঁর এই সাফল্য শুধু তাঁর পরিবারের জীবনমান উন্নত করছে না, বরং আশেপাশের শত শত চাষির কাছে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।