হোম অর্থ ও বাণিজ্য পাল্টা শুল্ক বেড়ে ২০%—দেশ কতটা সহ্য করতে পারবে?

পাল্টা শুল্ক বেড়ে ২০%—দেশ কতটা সহ্য করতে পারবে?

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 41 ভিউজ

নিউজ ডেস্ক:
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক আদায় করা হবে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ হলো পারস্পরিক বা পাল্টা শুল্ক এবং বাকি ১৫ শতাংশ গড় শুল্ক—যা আগে থেকেই কার্যকর ছিল। এই বাড়তি শুল্ক কে দেবে, কাদের ওপর এর প্রভাব পড়বে এবং বাংলাদেশের জন্য এর অর্থনৈতিক পরিণতি কী—তা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।

অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি ব্যবসায়ী মহল থেকেও বলা হচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে রফতানি খাতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এটি শুধুই সংকট নয়—একটি সম্ভাবনাও। যারা দ্রুত রফতানি প্রক্রিয়া, মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজার কৌশলে পরিবর্তন আনতে পারবে, তারাই টিকে থাকবে। সরকার, ব্যবসায়ী এবং শ্রমিক—সবার সম্মিলিত প্রস্তুতি দরকার এখন। কারণ, এই নতুন শুল্ক বাস্তবতায় যে টিকে থাকবে, তার জন্য মার্কিন বাজার এখনও বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র।

পাল্টা শুল্ক মানে কী?

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দুটি শব্দ প্রায়ই শোনা যায়—গড় শুল্ক আর পারস্পরিক বা পাল্টা শুল্ক। এগুলো বোঝা সহজ হলে শুল্ক নিয়ে দেশগুলোর অবস্থান ও সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গড় শুল্ক বলতে বোঝায়—একটি দেশ বাইরে থেকে যে পণ্য আমদানি করে, সেগুলোর ওপর গড়ে কত শতাংশ শুল্ক নেয়। ধরুন, একটি দেশে তিন ধরনের পণ্যে ১০ শতাংশ, ১৫ শতাংশ আর ৫ শতাংশ হারে শুল্ক নেওয়া হয়। তাহলে সেই দেশের গড় শুল্ক হবে ১০ শতাংশ। এই হিসাবটা সরলভাবে সব পণ্যের শুল্কের গড় বের করা হয়।

অন্যদিকে, পারস্পরিক বা পাল্টা শুল্ক হলো প্রতি-উত্তরমূলক শুল্ক। এর মানে, কোনও দেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ৬ শতাংশ শুল্ক বসায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও চাইলে ওই দেশের পণ্যের ওপর একই হারে ৬ শতাংশ শুল্ক বসাতে পারে। একে ইংরেজিতে বলে Reciprocal Tariff।

২০২৪ সালের ২ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্র নতুনভাবে এই পারস্পরিক শুল্কনীতি চালু করেছে। এখন তারা দেখে, কোন দেশ আমেরিকায় বেশি পণ্য বিক্রি করছে আর কম আমদানি করছে। যেখানে বড় ঘাটতি আছে, সেই দেশের ওপর বেশি হারে শুল্ক বসানো হচ্ছে, যাতে বাণিজ্যে ভারসাম্য আনা যায়।

এভাবে গড় শুল্ক বলে দেয় একটি দেশের সামগ্রিক শুল্ক হার কেমন, আর পারস্পরিক শুল্ক বোঝায় অন্য দেশ যেভাবে শুল্ক বসায়, সেভাবে জবাব দেওয়া।

শুল্ক বসানো মানে কী, কে দেয় এই টাকা?

শুল্ক মূলত কোনও দেশে আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপিত একটি কর। এই কর আরোপ করে সেই দেশের সরকার, আদায় করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শুল্কের অর্থ সরকার দেয় না—দিতে হয় আমদানিকারককে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাক আমদানি করলে সেই পণ্যের ওপর এখন ৩৫ শতাংশ শুল্ক বসবে। অর্থাৎ, মার্কিন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হবে। তবে তারা এই খরচ পণ্যের বিক্রয়মূল্যে যোগ করে দেন ক্রেতাদের ওপর।

ফলে এক অর্থে আমেরিকার সাধারণ জনগণই শেষ পর্যন্ত এই শুল্ক বহন করবে, যদিও সরাসরি তারা কিছু দিচ্ছে না। ফলে, বিদেশি পণ্যের দাম বাড়ে, বেড়ে যায় দৈনন্দিন খরচও।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বল্পমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের খুচরা দামে কিছুটা বৃদ্ধি হতে পারে এবং বিক্রিতে সাময়িক প্রভাব পড়তে পারে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলছে—বাংলাদেশ এ ধরনের বৈশ্বিক চাপে আগেও সফলভাবে টিকে থেকেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, বাড়তি এই ২০ শতাংশ শুল্ক আমদানিকারক ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকেই দিতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, গত এপ্রিলে প্রথম দফায় সব দেশের ওপর ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। সেই সময় অনেক ক্রেতা খরচ ম্যানেজ করলেও, কিছু প্রতিষ্ঠান আমাদের সদস্যদেরও সেই শুল্ক ভাগাভাগি করতে বাধ্য করেছে। আমি এখন স্পষ্ট করে বলতে চাই—বাড়তি এই শুল্ক আমদানিকারক ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকেই দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত তারা সেটি মার্কিন ভোক্তার ওপরই চাপাবে।

বিজিএমইএ সভাপতি সতর্ক করে বলেন, ‘বাড়তি শুল্কের কারণে কিছুটা ব্যবসা কমতে পারে। মার্কিন ক্রেতাদের আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হবে, যা তাদের মূলধনের ওপর চাপ তৈরি করবে। তারা যদি বাড়তি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে নতুন ক্রয়াদেশ কমে যেতে পারে। শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়লে মার্কিন ভোক্তারাই চাপে পড়বেন, ফলে বিক্রি কমে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকবে।’

মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, ‘গত তিন মাস ধরে আমরা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। এই অনিশ্চয়তা ব্যবসা পরিচালনার জন্য কঠিন পরিবেশ তৈরি করেছিল। এখন শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্তে স্থিতিশীলতা ফিরবে।’

তিনি বলেন, মার্কিন ক্রেতারাও এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত শুল্ক হার কিছুটা কমানোয় আমদানি ব্যয় কমবে এবং বাজারে আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে। ‘প্রতিযোগী দেশের তুলনায় যদি আমাদের পণ্যে শুল্ক বেশি হয়, তাহলে প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে পড়ে। এখন পাকিস্তানের তুলনায় ১ শতাংশ বেশি হলেও, ভারতের চেয়ে আমাদের শুল্ক ৫ শতাংশ কম। চীনের তুলনায় তো ১০ শতাংশ কম—এটি আমাদের জন্য বড় স্বস্তির।’

বাংলাদেশের পোশাক খাতে কী প্রভাব ফেলবে?

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম প্রধান বাজার। এই বাজারে যদি শুল্কহার বাড়ে, তাহলে পোশাক রফতানিতে কিছু স্পষ্ট প্রভাব পড়বে—

১। মূল্য প্রতিযোগিতা কমে যাবে

যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের পোশাকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করছে। আগামী ৮ আগস্ট থেকে এই হার বেড়ে ৩৫ শতাংশ গিয়ে দাঁড়াবে। এতে করে সেখানে নতুন এই হার পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। ফলে ক্রেতারা বাংলাদেশের তুলনায় ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা মেক্সিকোর মতো দেশের সস্তা পোশাকের দিকে ঝুঁকতে পারে।

ধরা যাক, আগে যুক্তরাষ্ট্রে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত একটি শার্টের দাম ছিল ১০ ডলার। আমদানিকারক তখন গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতো। এখন নতুন করে ২০ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ফলে মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৩৫ শতাংশ। সেই শার্টের দাম এখন ১৩ ডলার বা তার বেশি হতে পারে।

এর প্রভাব বাজারে মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে বোঝা যাবে। বিদেশি পণ্যের দাম বাড়লে পুরো বাজার ব্যবস্থাই প্রভাবিত হয়। মধ্যবিত্ত ক্রেতা থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে।

২। ক্রেতার খরচ বাড়বে

যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা পর্যায়ে পোশাকের দাম বাড়তে পারে। তবে এই বাড়তি শুল্ক সরাসরি আমদানিকারক বা ব্র্যান্ডদের ওপর চাপলেও তারা সেটি পুশ করে দিতে পারে বাংলাদেশের সরবরাহকারীর ওপর—ছাড় চেয়ে বা অর্ডার বাতিল করে।

৩। রফতানি আদেশ কমে যেতে পারে

বেশ কিছু ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান হয়তো নতুন করে বাংলাদেশের অর্ডার কমিয়ে দিতে পারে। কেউ কেউ হয়তো অর্ডার অন্য দেশে সরিয়ে নেবে। এতে করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর অর্ডার বুক কমে যেতে পারে।

৪। চাপ বাড়বে শ্রমিক-কর্মসংস্থানে

যদি অর্ডার কমে যায়, তাহলে অনেক কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। এতে চাকরিচ্যুতি, শ্রমিকদের ছাঁটাই বা ওভারটাইম বন্ধের মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে।

৫। কারখানাগুলোতে নগদ প্রবাহে টান

শুল্ক বৃদ্ধির কারণে অনেক কারখানার রফতানি আয়ের পরিমাণ কমে যেতে পারে। এতে করে ঋণ পরিশোধ, মজুরি পরিশোধ বা কাঁচামাল আমদানিতে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

৬। পুনর্মূল্যায়ন হবে বাণিজ্য কৌশলের

পোশাক রফতানিকারকরা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ইউরোপ, কানাডা বা পূর্ব এশিয়ার বাজারে বিকল্প খুঁজবে। আবার কিছু কারখানা হয়তো আরও উচ্চমূল্যের, পরিবেশবান্ধব বা বিশেষায়িত পণ্যের দিকে ঝুঁকবে, যাতে শুল্কের প্রভাব কম হয়।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আগে বাংলাদেশি পোশাকের ওপর ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক কার্যকর ছিল। নতুন ২০ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক যুক্ত হওয়ায় এখন মোট শুল্ক দাঁড়াচ্ছে ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত।

তিনি বলেন, “এই বাড়তি শুল্কে আমাদের প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হবে, তবে ভারত ও ভিয়েতনামও একইভাবে নতুন শুল্কের আওতায় পড়েছে, যা আমাদের জন্য কিছুটা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করেছে।”

হাতেমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী:

ভারতীয় পোশাক: আগে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পোশাকে ৮ দশমিক ৫ থেকে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক নেওয়া হতো। এখন ২৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক যোগ হওয়ায় মোট শুল্ক বেড়ে হয়েছে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ।

ভিয়েতনামের পোশাক: পূর্ববর্তী শুল্ক হার ছিল ৮ দশমিক ৫ থেকে ১৬ শতাংশ। যুক্ত হওয়া নতুন ২০ শতাংশ পারস্পরিক শুল্কে মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৫ থেকে ৩৬ শতাংশ।

এই বাড়তি শুল্ক মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেয়ার ট্রেড’ নীতির আওতায় আরোপিত হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে কার্যকর হওয়া এই সিদ্ধান্তের ফলে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে, তাদের রফতানি পণ্যে সমপরিমাণ পাল্টা শুল্ক বসানো হচ্ছে।

বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, “আমাদের চ্যালেঞ্জ এখন শুধু শুল্ক নয়, রফতানি আদেশ ধরে রাখাও কঠিন হয়ে উঠবে। তবে ভারত ও ভিয়েতনাম একই নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্র্যান্ডগুলো এখন দাম নিয়ে সমন্বয় করতে বাধ্য হবে।”

ট্যারিফ কীভাবে আদায় হয়, কে কাকে কী দেয়

শুল্ক বা ট্যারিফ আদায় হয় আমদানি প্রক্রিয়ার সময়। বিদেশি পণ্য বন্দরে আসার পর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো কাস্টমস বিভাগে নির্ধারিত হারে কর দেয়। এরপর তারা সেই পণ্য বাজারে ছাড়ে, যেখানে অতিরিক্ত খরচটি যুক্ত হয় পণ্যের মূল্যে।

সোজা করে বললে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক গেল, সেখানে কাস্টমস বিভাগে শুল্ক দেওয়া হলো এবং সেই টাকা মার্কিন আমদানিকারক পণ্যের দামে তুলে নিলো ভোক্তার কাছ থেকে।

বাংলাদেশের জন্য কী অর্থ বহন করে এই সিদ্ধান্ত?

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান পোশাক রফতানিকারক দেশ। ফলে এই সিদ্ধান্ত সরাসরি বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতকে প্রভাবিত করবে। তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, এই বাড়তি শুল্কের ফলে মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে চীনের ওপর কঠোর শুল্ক থাকায় বাংলাদেশ কিছুটা বাড়তি বাজার পেতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, এটি বাংলাদেশের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি একটি সম্ভাবনার জানালাও। চীনের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নতুন উৎসের দিকে তাকাবে, যেখানে বাংলাদেশ অন্যতম হতে পারে।

বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত অনেকাংশেই বাংলাদেশের জন্য খুশির খবর। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বাজার হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় প্রথমে ভারতকে সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের চেয়ে ভারতের ওপর বেশি শুল্ক নির্ধারণ হয়েছে—২৫ শতাংশ। এর মানে, মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশকেই চীনের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন।

তিনি বলেন, আমরা যদি দ্রুত উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারি, উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি এবং সময়মতো পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের রফতানি অনেক বাড়বে। বাংলাদেশের রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার। বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয় দেশটিতে। বিপরীতে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে।

তবে প্রতিযোগী দেশও কম নয়

ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো—এদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বড় অংশীদার হতে আগ্রহী। তারা ইতোমধ্যে উৎপাদন দক্ষতা, দ্রুত ডেলিভারি ও বৈচিত্র্যময় পণ্য সরবরাহে অগ্রসর। ফলে বাংলাদেশের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়বে।

বাংলাদেশকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। বাণিজ্য নীতিমালা ঢেলে সাজানো, উৎপাদনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং বৈচিত্র্য আনা এখন সময়ের দাবি।

বিশ্বব্যাপী কী প্রভাব পড়ছে ট্যারিফের

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কনীতির ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছে গাড়ি নির্মাতা, এয়ারলাইনস এবং ভোক্তা পণ্যের আমদানিকারকরা। ইলেকট্রনিক্স খাতেও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খাতও চাপের মুখে পড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুল্ক যখন ২০ শতাংশ বা তার বেশি হয়, তখন অনেক আমদানিকারকই বড় সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন। বিনিয়োগ কমে যায়, কর্মসংস্থান স্থবির হয়। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রে ২০ শতাংশ শুল্কেই স্বস্তি প্রকাশ, কূটনৈতিক বিজয় বলছে সরকার

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর নতুন করে ২০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারিত হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকার। দেশটির সঙ্গে একটি ‘যুগান্তকারী বাণিজ্য চুক্তি’র মাধ্যমে পূর্বঘোষিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এড়ানোয় একে কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে দেখছে নীতিনির্ধারকেরা।

শুক্রবার (১ আগস্ট) বিকালে এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন শুল্ক চুক্তি স্বস্তিদায়ক। সকালে বেইলি রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনেও এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে আমরা সফলতার অনুভব পেয়েছি।’

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই যুগান্তকারী বাণিজ্য চুক্তি করায় বাংলাদেশের আলোচকদের আমরা অভিনন্দন জানাই। এটি নিঃসন্দেহে একটি চূড়ান্ত কূটনৈতিক বিজয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০ শতাংশে শুল্ক নামিয়ে আনার মাধ্যমে আমাদের আলোচকরা অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় অসাধারণ কৌশলগত দক্ষতা ও অটুট প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছেন।’

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এড়াতে সক্ষম হয়েছি, যা আমাদের তৈরি পোশাক খাতসহ রফতানি নির্ভর অর্থনীতির জন্য একটি বড় অর্জন। এর ফলে আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাজারে প্রবেশাধিকার ধরে রাখতে পারবো।’

যুক্তরাষ্ট্র সরকার শুক্রবার এক ঘোষণায় জানায়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর নতুন শুল্কহার ১৫ শতাংশ হ্রাসপূর্বক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে এক সপ্তাহ পর থেকে।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেও আমরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে থাকবো। রফতানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল শুল্কহার আরও কম হবে।’

এই প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে শুক্রবার সকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হ্রাস নিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, ২০ শতাংশ হার আমাদের গ্রহণযোগ্য অবস্থানে রাখবে।’

সরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দীর্ঘ আলোচনার পর এই চুক্তি কার্যকর হয়েছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ চীন ও ভারতসহ আঞ্চলিক প্রতিযোগীদের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থান ধরে রাখতে পারবে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন