নিউজ ডেস্ক:
যখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে স্কুল ঘরে, তখন কেউ দৌড়ে যেতে চেয়েছেন সহপাঠীদের বাঁচাতে, কেউ নিজে আতঙ্কিত হয়ে অপলক তাকিয়ে রয়েছেন। বিস্ফোরণের সময় চোখের সামনে অনেককে আগুনে পুড়ে যেতে দেখে এখনও ঘুমান না রাতের পর রাত অনেকে। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ট্রমা কাটিয়ে উঠতে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করাচ্ছে। কিন্তু তারপরও স্কুল খোলার আগে আরও কিছু করণীয় আছে বলে মনে করেন শিশু অধিকারকর্মী, মানসিক স্বাস্থ্যবিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ ভালো, কিন্তু একইসঙ্গে ওই জায়গাতেই যদি স্কুল করাতে হয়— তবে তাদেরকে আরও কিছু মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। নতুনভাবে না ভাবলে, জোর করে যে চাপের মধ্যে পড়বে এই শিশুরা, সেটার দীর্ঘমেয়াদে ফল ভালো হবে না। এদিকে স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে— রবিবার (৩ আগস্ট) শোক সভা ও দোয়া মাহফিলের মধ্য দিয়ে সোমবার (৪ আগস্ট) নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির নিয়মিত ক্লাস শুরু করা হবে।
একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তার অভিজ্ঞতার কথা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাসায় সারা রাত লাইট জ্বালানো থাকে। মেয়ে নেভাতে দেয় না, ভয় পায়। আমি তার ঘরে থাকি এই কয়দিন ধরে। সে স্পষ্ট বলে দিয়েছে— এই স্কুলে আর যাবে না। আমরা ভাবছি, নতুন করে কোথায় ভর্তি করাবো? হয়তো সময় আরও কিছুটা পার হলে যাবে। কিন্তু এই যে ভয়টা ঢুকেছে, সেটা ওই জায়গাকে কেন্দ্র করে। ওখানে ঢুকলেই ওদের সব স্মৃতি মনে পড়ে যাবে। এই যে কদিন বাসায় থেকে, কাউন্সেলিং করিয়ে যে মলমটা লাগানো হলো, সেটা আর কাজ করবে না তখন।’
সেদিন ওই স্কুলের মাঠেই ছিলেন এমন এক অভিভাবক বলছেন, ‘সবই ঠিক আছে ধরে নিলাম। যে বিল্ডিং পুড়েছে সেখানে ক্লাস করাবেন না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কি একবারও বলেছে— তারা স্কুল অন্যখানে নিয়ে যাবে। বা আমরা অভিভাবকরা কি একবার ভেবে দেখেছি— কেন ওই জায়গাতে স্কুলটা থাকবে। আর এরকম ঘটনা যে ঘটবে না, তা কে বলতে পারবে। ফ্লাইং জোন নিয়ে এত কথা হলো, কিন্তু দাবিটা ঠিক আমরা উঠাতে পারলাম না।’
প্রথমে স্কুল খোলার কথা শোনা গেলেও পরবর্তী সময়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, আগে কাউন্সেলিং করে তারপর স্কুল খোলা হবে। সেখানে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধপত্র। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা কাউন্সেলিং আর চিকিৎসাসেবা নিতে মাইলস্টোনের ক্যাম্পাসে যাচ্ছেন। মানসিক আঘাতে (ট্রমা) ভুগছেন, এমন ব্যক্তিদের প্রয়োজন হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে পাঠানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
শিশু অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা গওহার নঈম ওয়ারা এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই একই জায়গায় স্কুল রেখে যদি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে হয়, তবে তাদের জন্য এমনকিছু করতে হবে, যাতে তাদের চিন্তার জগত ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়। সেটা শুধু পরামর্শ ও কাউন্সেলিংয়ের মধ্য দিয়ে সম্ভব বলে আমি মনে করি না। যেটা করতে হবে সেটা হলো— ওই মাঠে শিশুরা আসবেন, তাদের জন্য খেলার ব্যবস্থা করতে হবে। সেলিব্রেটিরা যাবেন, তাদের সঙ্গে খেলবেন। রঙ-পেন্সিল দিয়ে মাঠে বসাতে হবে। ধরা বাধা কোনও আনুষ্ঠানিকতা করে, বা জোর করে বসানো না। চারুকলার সংবেদনশীল একদল শিক্ষার্থী সারা দিন তাদের সঙ্গে ছবি নিয়ে কাটাক। এভাবে একটু একটু করে প্রস্তুত করতে হবে। আমার মাথায় এ দুটো আসলো, আরও কেউ ভাবলে আরও কিছু বের হবে। সম্ভব হলে প্রথম কয়েকদিন বাবা-মা বা যেকোনও অভিভাবক পুরোটা সময় স্কুলে সঙ্গে থাকুক এবং তাদের স্কুলের ভবনে না ঢুকিয়ে মাঠেই ব্যবস্থা করা হোক। আমার মনে হয় এসব ব্যবস্থা নেওয়া হলে ভয় কেটে যাবে।’
শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার আগে এই শিশুদের জন্য আরও কিছু করা দরকার উল্লেখ করে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসক মেখলা সরকার বলেন, ‘যেসব দুর্ঘটনায় সহপাঠী মারা গেছে, কাছের মানুষ মারা গেছে, যেখানে মৃত্যুটা তারও হতে পারতো— সেসব ক্ষেত্রে খুব ঝুঁকি কাজ করে। বিষণ্ণতা থেকে প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হতে পারে শিশুরা। হয়তো এ মুহূর্তে উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কয়েকমাস পরেও দেখা দিতে পারে। অভিভাবকদের সচেতন করে তোলার দরকার আছে। শিশুর স্কুলভীতি হলে সেটা শারীরিক ভীতির কারণ হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘কী ধরনের উপসর্গ দেখলে অভিভাবক অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন, সেটা তাকে জানতে হবে।’
মেখলা সরকার আরও বলেন, ‘তাই বলে কি সেই জায়গায় আর যাবোই না? যেতে হবে। কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে যেতে হবে। শুরুতেই শ্রেণিকক্ষে না নিয়ে তাকে স্কুলে যাতায়াত ও নানা অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে সহজ করে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে সবার চাপ নেওয়ার ক্ষমতা সমান না।’
স্কুল ও কলেজ খোলার বিষয়ে জানতে চাইলে মাইলস্টোনের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগামী রবিবার দোয়া মাহফিল ও শোকসভার আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্কুল খোলা হবে। সোমবার থেকে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে এখন কেবল নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস খোলা হবে।’