বিনোদন ডেস্ক:
সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার স্মরণ করলেন তার মা ইলা মজুমদারের সংগ্রামী জীবনের অনন্য অধ্যায়- যেদিন বাবা পণ্ডিত বারীণ মজুমদারকে ফিল্মি স্টাইলে মিউজিক কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়, বাসায় ফিরে তিনি গ্রেপ্তার হন, আর মায়ের কাঁধে এসে পড়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব।
শনিবার (৩ মে) বাপ্পার মা ইলা মজুমদারের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পারিবারিক একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন বাপ্পা। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, বাবার গ্রেপ্তার হওয়া থেকে এক রাতে বাস্তুহারা হয়ে যাওয়ার গল্প।
বাপ্পা মজুমদার লিখেছেন, ‘আমার ছোটবেলার সেই প্রিয় মিউজিক কলেজ থেকে যেদিন আমাদেরকে ফিল্মি স্টাইলে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল, সেই দিনটি আজও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। বাবা মিউজিক কলেজের দোতলায়… এলোমেলো চুল… গায়ের সেই পরিচিত কোটটা নেই… টাইটা গলায় ঝুলছে… বাবা দোতলা থেকে চিৎকার করে আমাদের বলছেন… ‘তোমরা যাও… আমি আসছি…।’ আর তখনকার আমি… সদ্য নার্সারিতে পড়ি…। একটা রিকশায় তুলে দেওয়া হলো আমাদের। মা ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছেন বাবার দিকে। দোতলা থেকে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে আমাদের ব্যবহৃত আসবাব আর সব কিছু। এক রাতে হয়ে গেলাম বাস্তুহারা!’
মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, দেশের একমাত্র সংগীত কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সংগীতাচার্য পণ্ডিত বারীণ মজুমদার। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কলেজটি ১৯৮৪ সালে সরকারি হয়। বারীণ মজুমদারের উদ্যোগে কাকরাইলের মনোয়ারা কিন্ডার গার্টেন শ্রেণিকক্ষে এ প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে কলেজ অব মিউজিক নামে। শুরুতে অধ্যক্ষ ছিলেন বারীণ মজুমদার। পরে সেগুনবাগিচা, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, গ্রিন রোডসহ বিভিন্ন ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হয় সেটি। ১৯৯২ সালের শেষ দিকে কলেজটি আবার আগারগাঁওয়ে নিজস্ব জমিতে ফিরে আসে।
সংগীত মহাবিদ্যালয় থেকে তাদের বের করে দেওয়ার পর মগবাজারের একটি বাসায় ঠিকানা হয় তাদের। সেখানে থেকে নতুন জীবন শুরু হয়।
সেই ঘটনা তুলে ধরে বাপ্পা লিখেছেন, ‘আমাদের আচমকা ঠিকানা হলো মগবাজারের একটি বাসায়। মেজদা, ফারুক কাকু আর বাবার কিছু ছাত্র-গুণগ্রাহীর সহায়তায়। বাবা সেই বাসায় আসার কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রেপ্তার হলেন মিথ্যা মামলায়। বাবা ফিরলেন ১৮ দিন পর। কাজকর্মহীন মানুষটি ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় হয়ে পড়লেন চরম হতাশ আর দিকহারা।’
পরিবারের ওই দুঃসময়ে হাল ধরেছিলেন বাপ্পার মা ইলা মজুমদার। বাপ্পার কথায়, ‘মা দূর্গার মতো সব সামলে নিতে পা বাড়ালেন ইলা মজুমদার। সংসারটাকে বাঁচাতে মরণপর যুদ্ধে নামলেন সেই অতিমানবী। চাকরি নিলেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে। সব যুদ্ধ জয় করলেন সেই মানুষটি। এক ভয়ংকর যুদ্ধে সব সামলে ধরলেন সংসারের হাল। আজ আমাদের অস্তিত্ব যদি টিকে থাকে, তার সর্বময় কৃতিত্ব আমার মায়ের, যার নাম ইলা মজুমদার। ইলা মজুমদার শুধু একটি নাম নয়, তিনি একজন উদাহরণ। তিনি শুধু একজন স্ত্রী বা মা নন বরং তার চেয়েও বড় একজন মানুষ, যিনি সবকিছু তুচ্ছ করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি কতটা শক্তিশালী। তিনি একজন সুপার হিউম্যান। এবং আমি প্রাউডলি বলি, আমি ইলা মজুমদারের ছেলে।’
সংগীতচর্চায় গড়ে ওঠা তাদের সিদ্ধেশ্বরীর বাসার স্মৃতিচারণা করতেও ভোলেননি বাপ্পা। বাবা বারীণ মজুমদার সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি অসম্ভব ভালো একজন স্বামী ও পিতা। একজন শিল্পীকে এই কম্বিনেশনে পাওয়া কঠিন। কার কিসের কমতি হলো, সেসব নিয়ে তিনি সজাগ থাকতেন, হয়তো প্রকাশ করতেন না। ছেলে ঠিকমতো পড়ছে কি না, খাচ্ছে কি না, সেসবের খেয়াল রাখতেন। বাবা বাজার ও রান্না করতে পছন্দ করতেন। শিকারে আগ্রহ ছিল, যদিও একপর্যায়ে সেটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মাছ ধরতে পছন্দ করতেন। ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন শৌখিন মানুষ। বাগান করতে ভালোবাসতেন। বাবা বলতেন, গাছেরা বাবাকে বোঝে। বাগানে নিজ হাতে কোদাল চালাতেন। সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় একটা পরিত্যক্ত জায়গায় বাবা বাগান করেছিলেন। তার হাতে লাগানো গাছে এত বড় ডালিয়া ফুল ফুটেছিল যে আমি নিশ্চিত, এত বড় ডালিয়া ফুল কেউ দেখেনি।’
বারীণ মজুমদার ১৯৮৩ সালে একুশে পদক ও ২০০২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। আর তার স্ত্রী ইলা মজুমদারের আত্মত্যাগ ও শক্তিময়তা ছেলে বাপ্পার স্মৃতিচারণে হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।
উল্লেখ্য, এ মুহূর্তে বাপ্পা মজুমদার আছেন কানাডায়। সেখানকার কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে কনসার্টে অংশ নিতে গত মাসে বাংলাদেশ ছাড়েন। আগামী সপ্তাহে তার ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে।