হোম রাজনীতি যে আইনে নিষিদ্ধ জামায়াত-শিবির, আইনে কী আছে?

যে আইনে নিষিদ্ধ জামায়াত-শিবির, আইনে কী আছে?

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 14 ভিউজ

রাজনীতি ডেস্ক:

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর ফলে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলটির।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারার ক্ষমতা বলে সরকার নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠন নিষিদ্ধ করেছে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আইনে কী বলা আছে?

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারায় সন্ত্রাসী কাজে জড়িত ব্যক্তি বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তালিকাভুক্তির বিষয়ে বলা আছে। এতে বলা আছে, সরকার, কোন ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কাজে জড়িত রয়েছে বলে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে ওই ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ‘সত্তা’ বলতে কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, অংশীদারি কারবার, সমবায় সমিতিসহ এক বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত যেকোনো সংগঠনকে বোঝানো হয়েছে।

এই আইনের ১৯ (১) ধারায় বলা আছে, ধারা ১৮ এর অধীন সরকারি আদেশে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা সত্তা আদেশের তারিখ হতে ৩০ দিনের মধ্যে, এর বিরুদ্ধে লিখিতভাবে, যুক্তি উপস্থাপনপূর্বক, সরকারের কাছে পুনঃনিরীক্ষার জন্য আবেদন করতে পারবে এবং সরকার, আবেদনকারীর শুনানি গ্রহণ করে এই আইনের অধীনে বিধি মোতাবেক আবেদন প্রাপ্তির তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পন্ন করবে।

পুনঃনিরীক্ষার আবেদন নামঞ্জুর করা হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা সত্তা আবেদন নামঞ্জুর হওয়ার তারিখ হতে ৩০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করতে পরবে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে তালিকাভুক্ত কোন ব্যক্তি বা নিষিদ্ধ সত্তার বিরুদ্ধে সরকার অন্যান্য কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারবে তা বর্ণিত আছে আইনের ২০ (১) ধারায়।

এতে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা সত্তাকে নিষিদ্ধ করা হলে এই আইনে বর্ণিত অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও সরকার, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, নিম্নবর্ণিত যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যথা:-

(ক) ওই সত্তার কার্যালয়, যদি থাকে, বন্ধ করে দিবে;

(খ) ব্যাংক এবং অন্যান্য হিসাব, যদি থাকে, অবরুদ্ধ করবে, এবং এর সকল সম্পত্তি জব্দ বা আটক করবে;

(গ) নিষিদ্ধ সত্তার সদস্যদের দেশ ত্যাগে বাধা নিষেধ আরোপ করবে;

(ঘ) সকল প্রকার প্রচারপত্র, পোস্টার, ব্যানার অথবা মুদ্রিত, ইলেকট্রনিক, ডিজিটাল বা অন্যান্য উপকরণ বাজেয়াপ্ত করবে; এবং

(ঙ) নিষিদ্ধ সত্তা বা তার পক্ষে বা সমর্থনে যে কোনো প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা, মুদ্রণ বা প্রচারণা, সংবাদ সম্মেলন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা দেয়া নিষিদ্ধ করবে।

(২) নিষিদ্ধ সত্তা তার আয় ও ব্যয়ের হিসাব সরকার মনোনীত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করবে এবং আয়ের সব উৎস প্রকাশ করবে।

(৩) যদি প্রতীয়মান হয় যে, তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা নিষিদ্ধ সংঘটনের সম্পত্তি অবৈধভাবে অর্জিত অথবা এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত হয়েছে, তাহলে ওই সম্পত্তি আদালত কর্তৃক রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে।

যে কারণে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করল সরকার

জামায়াত–শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। আপিল বিভাগ ওই রায়কে বহাল রেখেছেন।

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল বলে সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য–প্রমাণ রয়েছে। সরকার বিশ্বাস করে, জামায়াতে ইসলামী, শিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত।

তাই জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব দল ও সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের বিষয়ে আইনি মতামত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই মতামত পাঠানোর পর দুপুরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আর এই দলের অধীনে ও এসব নামে রাজনীতি করতে পারবে না।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছিলেন সরকারের মন্ত্রীরা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় সভায় জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হন ওই জোটের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেই বৈঠক হয়। জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্তের পর এখন সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হলো।

আদালতের রায়ে ২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে। জামায়াতের পক্ষ থেকে আপিল কলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের পক্ষের আপিল খারিজ করে দেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায়ও কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার জন্য সরকার কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করলেও এখনও সে বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি।

জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের পর এসব সংগঠনের সদস্যদের এখন বিচারের আওতায় আনা হবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে আইন আছে। তারা যদি বাংলাদেশের আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করেন, তাহলে অবশ্যই বিচার হবে। তবে জামায়াতে ইসলামীর যেসব নতুন কর্মী ১৯৭১ সালের পরে জন্ম নিয়েছেন, তাদের গণহারে বিচার করা হবে না।

তাদের সম্পদের কী হবে? এমন প্রশ্নে আনিসুল হক জানান, সেগুলোরও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।

নিষিদ্ধ হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যেতে পারেন কি না, একজন সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, তাদের কী হয়েছে? আপনারা নকশালবাড়ির ইতিহাস জানেন। অনেক দল যেতে পারে আন্ডারগ্রাউন্ডে। কিন্তু আমি বলেছি, সেটা মোকাবিলার প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।

এ নিয়ে চার বার নিষিদ্ধ হলো জামায়াত

১৯৪১ সালে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকে এনিয়ে চারবার নিষিদ্ধ হয়েছে দলটি। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয় জামায়াত।

’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল জামায়াতে ইসলামী। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে অন্য তিনটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়েছিল। সেবার নিষিদ্ধ করা হয় ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে।

পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত। দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘও নাম পরিবর্তন করে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে।

এরপর জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি নব্বইয়ের দশকেই সামনে এসেছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন থেকে। এই দাবি নতুন করে জোরালোভাবে সামনে আসে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়।

গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর শরীকদের অনেক নেতা বিভিন্ন সময় একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু এতদিন দলটিকে নিষিদ্ধের দাবি অপূর্ণই থেকে গেছে।

আদালতের রায়ে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেলেও দল হিসেবে জামায়াত ছিল সক্রিয়। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরেও তাদের মিছিল সমাবেশ করতে দেখা গেছে।

সবশেষ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ব্যবহার করে ব্যাপক সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগের পর জামায়াতকে নিষিদ্ধ করল সরকার।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন