শিক্ষা ডেস্ক:
শিক্ষার্থীদের মধ্যে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। গেল বছর দেশে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ৫১৩ শিক্ষার্থী। অভিমান ও প্রেমের সম্পর্কের মতো আবেগের কারণে আত্মহত্যার হার বেশি। শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। আর নারী ও স্কুলগামীদের মধ্যে আত্মহত্যার হারও আশঙ্কাজনক।
এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলেন এক শিক্ষার্থী। বর্তমানে পড়াশোনা করছেন রাজধানীর একটি নামকরা কলেজে। ছোটবেলায় ছিল বড় হওয়ার স্বপ্ন, সুন্দর করে বাঁচার পাশাপাশি মন জাগে ভালোবাসা পাওয়ার। কিন্তু মানুষ নাকি পাওয়ার থেকেও না পাওয়াটাই বেশি মনে রাখে। তার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এই বয়সে যখন পড়াশোনা, পরিবার আর বন্ধুদের নিয়ে ভালো সময় কাটানোর কথা, সেই বয়সে অভিমান, প্রিয় মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আর পারিবারিক বিরোধের হতাশা থেকে আত্মহননের পথে পা বাড়ানোর মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেন তিন-তিনবার।
গেল বছর সারা দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পারিবারিক বিভেদ, পড়াশোনার চাপ, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে অভিমান আর হতাশায় ৫১৩ শিক্ষার্থীর আত্মহননের চিত্র উঠে এসেছে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায়। যেখানে অভিমান ও প্রেমের সম্পর্কের মতো আবেগের কারণে আত্মহত্যার হার ৪৭ শতাংশ।
পরিসংখ্যান বলছে, ৫১৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৭ শতাংশের বয়স ১৩-১৯ বছর। আত্মহত্যার হারে শীর্ষে ঢাকা বিভাগ। আত্মহননের পথ বেছে নেয়া বেশিরভাগই নারী শিক্ষার্থী। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ সম্পর্কের টানপোড়েন ও অভিমান।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মনের কথা খুলে বলার সুযোগ সীমিত হয়ে আসায়, সহজেই এসব ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কিশোর থেকে শুরু করে তরুণরা। পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক পরিচর্যার ওপর গুরুত্বারোপের পরামর্শ দেন মনোবিজ্ঞানীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, ‘আত্মহত্যার কারণ দুটি। একটি জীবনে যখন কোনো যন্ত্রণা আসছে, তখন সমাধান হিসেবে আত্মহত্যার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে। দ্বিতীয়টি আমাদের সমাজে সাপোর্ট সিস্টেম। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বড় কারণ অভিমান। নিকটজনের সঙ্গেই এ অভিমান হচ্ছে। প্রেমের সম্পর্কের একটা বিষয়ও উঠে এসেছে। সম্পর্ক ছিন্ন বা প্রত্যাশার প্রাপ্তি না হওয়ায় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষার ফলাফল বিষয়টিও অত্মহত্যার অন্যতম কারণ। পরীক্ষায় পাস করেছে, কিন্তু জিপিএ আকাঙ্ক্ষিত হয়নি। ফলে আত্মহত্যা করছে। চাকরির পরীক্ষায় ব্যর্থতায়ও এমন কাজ হচ্ছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও মনমালিন্যের কারণেও অনেকে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।’
ঢাবির এই অধ্যাপক মনে করেন, ‘অনেকাংশে ঘটনাগুলোর প্রতিরোধ সম্ভব। তবে এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। এ জায়গায় এখনও আমাদের ঘাটতি রয়েছে। বাবা-মাকে সচেতন করার বিষয় আছে। তাদের একটা আচরণ আছে শিশুদের মনে আঘাত করে। এতে আত্মহত্যার বিষয়টি প্ররোচিত করে। সেগুলো এড়িয়ে চলতে পারলে আত্মহত্যা বন্ধ হতে পারে।’
‘সন্তানকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে মানসিক চাপে পড়ে যায় শিক্ষার্থীরা। ভালো ফল না পেলে অত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। শিক্ষকরা যখন কটূ কথা বলছেন তখনও এমনটা ঘটছে। বিদ্যালয় শিক্ষকরা অনেক সময় বৈষম্যমূলক আচরণ করে ফেলেন, যেমন ভালা ছাত্র-খারাপ ছাত্র। বিষয়গুলো এড়িয়ে চললে ভালো ফল আসতে পারে,’ যোগ করেন তিনি।
কামাল চৌধুরী বলেন, ‘যে আত্মহত্যা করছে আইনে চোখে তাকেই দোষী করা হচ্ছে। কিন্তু যারা তাকে প্ররোচিত করছে তাদের দায়দায়িত্ব বেশি। একটা মানুষ হঠাৎ আত্মহত্যা করে না। কিছু পরিবর্তন আসে। সেগুলো চিহ্নিত করতে পারলে এমন কাজ কমে আসবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমাজ ও পরিবারের করণীয় আছে। সেই করণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। সন্তানদের চাপ সৃষ্টি না হয় অভিভাবকরা এমন কী পদক্ষেপ নিতে পরেন জানানো। বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সচেতন করতে হবে।’
অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক প্রত্যাশা আর প্রতিযোগিতার মানসিকতায় চাপ বাড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেকে বঞ্চিত ও বিচ্ছিন্ন মনে না করেন, এজন্য অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব বলেন, ‘সাফল্যের চাবিকাঠি অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতা বেশি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা চাপ তৈরি হয়। মাথায় ঢোকে তাকে ভালো লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে হবে। আমরা যে দেশে বসবাস করি এখানে শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের পরিবার থেকে আসছে। সবাই কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। তাই ভালো ফল করতে না পারলে মনে আঘাত আনে, তখন মানসিক চাপ বোধ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সমাজ থেকে তাদের গুটিয়ে নেয়। নিজেকে ব্যর্থ হিসেবে ট্রিট করে। এখানে পরিবারের অনেকটা দায় রয়েছে। এছাড়া প্রতিবেশীর সমালোচনার সংস্কৃতির কারণেও শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রভাব পড়ে। ট্রমায় থাক, তখন মনে করে তাকে দিয়ে কিছু হবে না, জীবন রেখে লাভ কী। তাই এসব বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। দেশের সর্বস্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক পরিচর্যাকেন্দ্র এবং পর্যাপ্ত মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের প্রয়োজন।’