বাণিজ্য ডেস্ক:
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিককে অবমাননাকরভাবে উপস্থাপন করায় নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
রোববার (৩১ ডিসেম্বর) বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, সম্প্রতি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে নারী পোশাক কর্মীরা কারখানা এবং পতিতালয়ে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, যা অত্যন্ত আপত্তিকর। এই প্রতিবেদনে অত্যন্ত অবমাননাকরভাবে পোশাক শিল্প সম্পর্কে ঢালাওভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা নিন্দনীয়। বিজিএমইএ গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের ব্যাপারে তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে।
এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের মূল অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি, পোশাক শিল্পের মাধ্যমে দেশের নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও অগ্রগতি অর্জন হয়েছে, তাকে প্রকারান্তরে ম্লান করে দেয়। এই প্রতিবেদনটি আমাদের কাছে অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে। কারণ এতে একজন পোশাক কর্মীর কথা বলা হয়েছে, যিনি একটি বড় পোশাক কারখানায় কাজ করে, অথচ কারখানার নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। প্রতিবেদনে যে স্থানে কারখানাটি অবস্থিত বলা হয়েছে, সেখানে আদতে কোনো রফতানিমুখী পোশাক শিল্প কারখানা নেই।
বিজিএমইএ জানায়, মানুষের ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট থাকে, থাকতেই পারে। কিন্তু তাই বলে নারী কর্মীদেরকে একটি একক স্বতন্ত্র সংগ্রামের মধ্যে আবদ্ধ করার চেষ্টা করা হলে তা শুধুমাত্র ভুলই হবে না; বরং এভাবে নারীদেরকে সংজ্ঞায়িত করা নারী কর্মীদের বিরুদ্ধে মৌলবাদ উসকে দেয় এবং নারীদের জীবিকা নির্বাহের উপায়টি বিপন্ন ও আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। এই ধরনের আখ্যান পরিবার, সমাজ এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের মর্যাদাহানী করে, জীবনকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তাদের অদম্য প্রয়াসকে নিরুৎসাহিত করে দেয়।
এই প্রতিবেদনগুলো কর্মক্ষেত্রে নারীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা স্থায়ী করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি শিল্পকে অবমাননাকরভাবে উপস্থাপন করে। বাস্তবিকভাবে পোশাক শিল্পটি দেশের লাখ লাখ নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের জীবন বদলে দিয়েছে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে।
১৯৮৩ সালে দেশে মোট শ্রমশক্তিতে নারীদের হার ছিল মাত্র শতাংশ, যা বর্তমানে ৩৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নারীরা বিস্ময়করভাবে ৩৪ শতাংশ অবদান রাখছে এবং এই অবদান রাখার হার দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কম সাক্ষরতা এবং দক্ষতা সম্পন্ন লাখ লাখ সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের জন্য পোশাক শিল্প হলো কর্মসংস্থানের প্রথম আনুষ্ঠানিক খাত। এই শিল্পের মাধ্যমে নারীরা একদিকে তাদের পরিবারকে সাহায্য করছে, অন্যদিকে নিজেরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক ক্ষমতায়ন অর্জন করেছে।
এ শিল্পের কল্যানে বাল্যবিবাহ এবং বাল্য-মাতৃত্ব হ্রাস পাচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের তালিকাভুক্তি বাড়ছে, এমনকি অনেক স্কলার এটিও মনে করেন যে, পোশাক শিল্প মেয়েদেরকে লেখাপড়ার জন্য বিদ্যালয়মুখী করেছে। মা ও শিশু স্বাস্থ্য সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে।
পোশাক শিল্পে মেয়েরা শুধুমাত্র ফ্লোরে কাজ করছে, বিষয়টা এমন নয়। এখন মেয়েরা শিল্পের উচ্চ পদগুলোতে আসীন হচ্ছে, তারা তাদের প্রতিভা কাজে লাগিয়ে শিল্পের প্রযুক্তিগত বিভিন্ন বিভাগে, যেমন শিল্প প্রকৌশল, পণ্য ডিজাইনিং ও মার্চেন্ডাইজিং প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলোতে অবস্থান গ্রহন করছে, একইসঙ্গে নেতৃত্ব প্রদানকারীর ভূমিকাতেও তাদেরকে দেখা যাচ্ছে। কারখানা ছেড়ে চলে গেলেও পরবর্তীতে কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তারা নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। পোশাক শিল্পকে উদ্যোক্তা গড়ে তোলার ক্ষেত্র বলা যায়। শিল্পের পটভূমি আর বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না রেখে দূর থেকে একটি প্রতিবেদন লেখার সময় প্রতিবেদককে অবশ্যই শিল্পের সঠিক ন্যারেটিভ জানতে হবে।
বিজিএমইএ আরও জানায়, শিল্পের কল্যাণে লাখ লাখ নারী দারিদ্র্যসীমা থেকে বের হয়ে আসছে, দক্ষতা অর্জন করছে এবং নিজেদের ও স্ব স্ব পরিবারের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ রচনা করছে। এসবের বাইরে উচ্চ শিক্ষার জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহিলা কর্মীদের স্বপ্ন পূরণে শিল্পটি অদ্ভূতপূর্ব অবস্থান নিয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৯০ জন তরুন পোশাক নারী কর্মী পাথওয়েজ ফর প্রমিজ প্রোগ্রামের অধীনে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করছে। যখন মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ন বৃত্তি নিয়ে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়ন করে, তখন নিয়োগকর্তা কারখানাগুলো তাদের পুরো পড়াশোনার মেয়াদে তাদেরকে সম্পূর্ণ মজুরি প্রদান করে।
পোশাক শিল্প দেশের বিস্ময়কর রূপান্তর, নারীদের ক্ষমতায়ন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার গল্প বলে। তাই সকলে মিলে পোশাক শ্রমিকদের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। যাতে বাংলাদেশের সকল নারীরা, কারখানার ভেতরে ও বাইরে আত্মমর্যাদা সহকারে কাজ করে নিজেদের উন্নতি করতে পারে।