আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ইউরোপের মাটিতে বেজে ওঠে নতুন যুদ্ধের দামামা। প্রায় দুই বছর আগে ইউক্রেনের মাটিতে রুশ সেনারা ঢুকে পড়ার পর এই প্রথম মনে হচ্ছে, যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জয় পেতে পারেন। তিনি রাশিয়াকে এখন পর্যন্ত লড়াইয়ের ময়দানে ভালোভাবেই রেখেছেন এবং দেশের ভেতরে ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করেছেন। তিনি একদিকে বিভিন্ন দেশ থেকে সামরিক সহায়তা অর্জন করেছন অপরদিকে ‘গ্লোবাল সাউথ’কে আমেরিকার বিরুদ্ধে যেতে সহায়তা করছেন। এছাড়া ইউক্রেনকে নিয়ে পশ্চিমাদের যে আত্মবিশ্বাস তা ভেঙে ফেলতে পেরেছেন।
পুতিনের বিজয় যে কারণে সম্ভব তা হল- এই যুদ্ধে জয় পরাজয়ের সমীকরণটা এলাকা দখলের চেয়ে টিকে থাকার মধ্যেই নিহিত। বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রের যে পরিস্থিতি তাতে কোনো পক্ষের সেনারাই শত্রু পক্ষকে তাড়িয়ে দেয়ার অবস্থানে নেই। ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ থমকে গেছে। ডনবাস অঞ্চলে আভদিভকা শহর দখলের লড়াইয়ে প্রতিদিন রাশিয়া বহু সেনা হারাচ্ছে।
এই যুদ্ধ ডিফেন্ডারদের। আক্রমণে গেলেই ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে। ফলে এই লড়াই বহু বছর ধরে চলতে পারে।
তবে, যুদ্ধক্ষেত্র রাজনীতির রূপ দেয়। ময়দানের গতিপ্রকৃতি মনোবলকে প্রভাবিত করে। ইউক্রেনের সেনারা পিছু হটলে কিয়েভে জেলনস্কি-বিরোধী মত আরও দ্রুত বাড়বে। পশ্চিমারাও বলবে, ইউক্রেনকে অর্থ ও অস্ত্র পাঠানো নিছক একটি অপচয়।
অন্তত ২০২৪ সালে রাশিয়া যুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে। কারণ, তাদের কাছে প্রচুর ড্রোন এবং আর্টিলারি শেল থাকবে। রুশ সেনারা ইউক্রেনীয় অস্ত্রের বিরুদ্ধে সফল ইলেকট্রনিক-যুদ্ধ কৌশল তৈরি করতে পেরেছে। আর পুতিনও তার সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করে যাবেন।
বৈদেশিক সমর্থন বৃদ্ধি যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়াকে সুবিধা দিচ্ছে। পুতিন ইরান থেকে ড্রোন এবং উত্তর কোরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ আর্টিলারি শেল পেয়েছেন। তিনি গ্লোবাল সাউথের অধিকাংশ দেশকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, ইউক্রেনের সাথে যা ঘটবে তাতে তোমাদের বড় কোনো ঝুঁকি নেই। তুরস্ক এবং কাজাখস্তান রাশিয়ান যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের রুট হয়ে উঠেছে।
রাশিয়ান তেলের আয় সীমিত করতে অপরিশোধিত তেলে পশ্চিমাদের প্রাইস ক্যাপ (প্রতি ব্যারেল সর্বোচ্চ ৬০ ডলার) নির্ধারণ ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, পশ্চিমাদের নাগালের বাইরে সমান্তরাল আরেকটি বাণিজ্য কাঠামো আবির্ভূত হয়েছে। রাশিয়ার উরাল ক্রুডের দাম বর্তমানে ব্যারেল প্রতি ৬৪ ডলার, যা ২০২৩ সালের শুরুর দিকের দামের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি।
পুতিনের জয় পাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, তিনি নিজ ঘরে অবস্থান শক্তিশালী করেছেন। তিনি রাশিয়ানদের খুব সহজেই বুঝাতে পারবেন যে, তারা পশ্চিমের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াই করছে। সাধারণ রাশিয়ানরা যুদ্ধ পছন্দ না করলেও তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। উচ্চবিত্তরা অর্থনীতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত করেছেন এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করছেন। লড়াই করে মারা যাওয়া সেনাদের পরিবারকে আজীবন মজুরি দেয়ার সক্ষমতাও আছে পুতিনের।
এসবের মুখে কিয়েভের আকাশে ভয়ের ঘন মেঘ জমলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। দেশটিতে রাজনীতিও ফিরে এসেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং সবচেয়ে সিনিয়র জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনির মত মিলছে না। জরিপ বলছে, দুর্নীতি কেলেঙ্কারি এবং ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ভোটারদের মধ্যে জেলেনস্কির অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে।
পশ্চিমা সরকারগুলো বরাবরই জোর দিয়ে বলছে, তারা ইউক্রেনকে সহায়তা চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বিশ্বজুড়ে তাদের এই প্রতিশ্রুতির বিষয়ে সন্দেহ আছে। মার্কিন কংগ্রেসে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল ছাড় করার জন্য বাইডেন প্রশাসনের ঘাম ঝরে যাচ্ছে। শিগগিরই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে আমেরিকা হঠাৎ করে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে।
ইউক্রেনকে ৫০ মিলিয়ন ইউরো দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু হাঙ্গেরি সেটি আটকে দিয়েছে। ইইউতে ইউক্রেনের সদস্যপদের বিষয়ে আলোচনা শুরু হবে বলে প্রত্যাশা করা হলেও অনেকে মনে করেন, এই প্রক্রিয়াটি ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ করা হবে। কারণ ইইউ বড় করা কঠিন এবং ইউক্রেনকে যুক্ত করা ইউনিয়নের স্বার্থের জন্য হুমকিস্বরূপ।
পুতিনকে অবশ্যই ইউরোপের প্রধান এবং দীর্ঘমেয়াদী হুমকি হিসেবে বিবেচনা করাতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া নতুন করে আবারও অস্ত্রে সজ্জিত হবে। তখন তাদের যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতাও থাকবে। এসব মাথায় নিয়েই ইউরোপকে পরিকল্পনা সাজাতে হবে, যেন প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউরোপের প্রতিরক্ষাকে দুর্বল মনে করার সুযোগ না পান। ন্যাটোর কোনো দেশে আক্রমণ চালানো হলে পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প (যদি আবার নির্বাচিত হন) ইচ্ছুক কি না তা নিয়ে যেন কোনো সন্দেহ পুতিনের না থাকে।
** দ্যা ইকোনোমিস্ট থেকে ভাবানুবাদ।