রাজনীতি ডেস্ক:
গত পাঁচ বছরে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানের ব্যবসায়িক আয়ের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামায় এমনটাই উল্লেখ করেছেন এ আসনে তিনবারের নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান।
২০১৪ সালে দশম এবং ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এর আগে ১৯৯৬ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম ওসমান। এবারও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তিনি। প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাইয়ের শেষ দিন আজ (৪ ডিসেম্বর) তার মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এখন পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। গত দশ বছরে নিজের নির্বাচনী এলাকা ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জে ব্যাপক উন্নয়নও করেছেন তিনি। যার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পুনরায় আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। দেশ বিদেশে আলোচিত এই সংসদ সদস্যের গত পাঁচ বছরে নিজের সম্পদের পরিমাণ কমলেও বেড়েছে ঋণের পরিমাণ। গত ২৯ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামায় এমন তথ্য উল্লেখ করেছেন তিনি।
হলফনামায় উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর পূর্বে শামীম ওসমানের নামে ১০ কোটি ৬০ লাখ ৭৪ হাজার ৮৩৯ টাকার অস্থাবর সম্পদ ছিল। যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৯৮ লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৭ টাকায়।
বন্ধু ও ব্যাংকের কাছে একক এবং যৌথভাবে তিনি দেনা ও ঋণ আছেন ২২ কোটি ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৭৬ টাকা। পাঁচ বছর আগে যা ছিল ১৩ কোটি ৮৮ লাখ ৭ হাজার ৮১৭ টাকা।
শিক্ষাগত যোগ্যতায় বিএ, এলএলবি ডিগ্রি সনদধারী সংসদ সদস্য শামীম ওসমান তার আয়ের উৎস হিসেবে বেশ কয়েকটি ব্যবসার কথা উল্লেখ করেছেন হলফনামায়। বর্তমানে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পাঁচটি। যা গত নির্বাচনের সময় উল্লেখ ছিল চারটি।
ব্যবসা খাতে শামীম ওসমানের আয় সামান্য বেড়েছে। গতবার ব্যবসা খাতে তার আয় ছিল ২২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এবার দেখানো হয়েছে ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৫২ টাকা। তবে স্থাবর সম্পত্তি ১ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ৭৫০ টাকা এবারও অপরিবর্তিত রয়েছে।
মামলার বিষয়ে এই সংসদ সদস্য হলফনামায় নিজের বিরুদ্ধে ফৌজদারি, অস্ত্র আইন ও দুর্নীতি দমন কমিশন আইনসহ মোট ১৭টি মামলার তালিকা উল্লেখ করেছেন। তবে এই মামলাগুলোর মধ্যে তিনটিতে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ, চারটি রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রত্যাহার করা হয়। বাকিগুলোতে তিনি খালাস ও অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন।
সংসদ সদস্য শামীম ওসমান তার মালিকানাধীন পাঁচটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কথা হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- জ্বালানি তেল আমদানি, পরিবহন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স জেডএন কর্পোরেশন, শিপিং (পণ্য এবং জ্বালানি পরিবহন) প্রতিষ্ঠান জেড এন শিপিং লাইন্স লিমিটেড, শিপিং (জ্বালানি পরিবহন) প্রতিষ্ঠান মাইশা এন্টারপ্রাইজ, খান ব্রাদার্স ইনফোটেক লিমিটেড এবং উইজডম নিটিং মিলস লিমিটেড।
খান ব্রাদার্স ইনফোটেক লিমিটেড এবং উইজডম নিটিং মিলস্ লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান দু’টি তার নামে নতুন যুক্ত হওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দাখিল করা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল না।
শামীম ওসমান তার ব্যবসা বাবদ ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৫২ টাকা আয় দেখিয়েছেন। ৫ বছর পূর্বে তার এই খাতে আয় ছিল ২২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে আয় সামান্য পরিমাণ বেড়েছে। তবে দেনা ও ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন তিনি।
দেনা ও ঋণ: পাঁচ বছর পূর্বে জেডএন শিপিং লাইন্স, শীতল এসি ট্রান্সপোর্ট ও মাইশা এন্টারপ্রাইজ নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ১২ কোটি ৩৭ লাখ ২৪ হাজার ৪৬৭ টাকা ঋণ ছিল শামীম ওসমানের। গত ১০ বছর যাবত সংসদ সদস্য থাকা শামীম ওসমান তার নামে দেনা ও ঋণের পরিমাণ বেড়েছে বলে উল্লেখ করেছেন হলফনামায়।
বিদেশি বন্ধু, ব্যাংক, গাড়ির ঋণ ও ক্রসচেকের মাধ্যমে শামীম ওসমানের দায়-দেনার পরিমাণ বর্তমানে দুই কোটি ছয় লাখ ১২ হাজার ৩৭৬ টাকা। একই খাতে পাঁচ বছর পূর্বে তার দেনা ও ঋণ ছিল ১ কোটি ৫ লাখ ৮৩ হাজার ৩৫০ টাকা।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ২০২৩-২৪ আয়কর বর্ষে কর বিবরণী অনুযায়ী ক্রসচেকের মাধ্যমে এক কোটি টাকা এবং প্রবাসী বন্ধু অনুপ কুমার সাহার কাছে ২০২৩-২৪ আয়কর বিবরণী অনুযায়ী সুদবিহীন ২৬ লাখ ৬৯ হাজার ৯৫০ টাকা ঋণ আছেন শামীম ওসমান।
এছাড়া যৌথভাবে আইএসআইসি ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ শাখায় জেডএন শিপিং লাইসেন্স ও মাইশা এন্টারপ্রাইজের বিপরীতে মোট ২০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে তার।
হলফনামায় তার নামে সোনারগাঁ উপজেলার বারদী ইউনিয়নের চরহাজী গ্রামে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ১২৩ শতাংশ কৃষি জমি রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তবে কৃষি খাতে তার কোন আয় দেখাননি।
বাড়ি বা দোকান ভাড়া বাবদ আয় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা উল্লেখ করেছেন। যা পাঁচ বছর আগে ছিল ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬৪ টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানতের সুদ হিসেবে তার আয় ১৫ লাখ ৭৯ হাজার ৫৪১ টাকা। যা আগের নির্বাচনী হলফনামায় ছিল ১৩ লাখ ৬৩ হাজার ৬৮১ টাকা।
এছাড়া তিনি হলফনামায় পারিতোষিক এবং সংসদ সদস্য হিসেবে সম্মানী বাবদ আয় দেখিয়েছেন যথাক্রমে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ১৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা।
অস্থাবর সম্পত্তি: চলতি বছরের ৩০ জুনের হিসেবে শামীম ওসমান তার নগদ টাকার পরিমাণ দেখিয়েছেন ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ৫৯২ টাকা। একইসাথে তার কাছে বৈদেশিক কোন মুদ্রা নেই বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
চলতি বছরের ৩০ জুন অনুযায়ী তার নামে আইএফআইসি ব্যাংকের একটি হিসেবে ৭৩ লাখ ৪ হাজার ৬৮৯ টাকা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া বন্ড, ঋণপত্র ও শেয়ার বাবদ শামীম ওসমানের নামে রয়েছে তিন কোটি ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫৪ টাকা। পাঁচ বছর পূর্বে এই খাতে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৩৮ লাখ ৫৩ হাজার ৯০ টাকা।
তার নামে আইএফআইসি ব্যাংকের একটি হিসেবে ২ কোটি ৪৯ লাখ ১ হাজার ৬৪৬ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রয়েছে। পাঁচ বছর পূর্বে আইএফআইসি ও সিটি ব্যাংকের চারটি হিসেবে ৪ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার ৮৭৯ টাকার স্থায়ী আমানত ছিল।
স্থাবর সম্পদ: কৃষি, অকৃষি, পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি ও বাড়িসহ শামীম ওসমানের নিজ নামে এক কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ রয়েছে।
পূর্বের হলফনামায় ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবে ৫৬ লাখ ৯৩ হাজার ১৬৬ টাকা মূল্যের একটি টয়োটা ল্যান্ডক্লুজার গাড়ি ছিল শামীম ওসমানের। এবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৮১ লাখ ৭৬ হাজার টাকার আরেকটি টয়োটা ল্যান্ডক্লুজার গাড়ি। এছাড়া তার নামে ৫ লাখ টাকার বৈদ্যুতিক সামগ্রী, ৫ লাখ টাকার আসবাবপত্র, ৩৮ তোলা স্বর্ণ রয়েছে।
অস্ত্র: বৈধ অস্ত্র ও লাইসেন্সের ব্যাপারে শামীম ওসমান উল্লেখ করেছেন, এর আগে এক লাখ ৫ হাজার টাকা মূল্যের তার একটি ‘এনপিবি পিস্তল’ ছিল। এবার তার সঙ্গে এক লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের ২২ বোরের একটি রাইফেল যুক্ত হয়েছে।
স্ত্রী-কন্যার আয় ও সম্পদ: শামীম ওসমান তার ওপর নির্ভরশীল হিসেবে তার স্ত্রী ও কন্যাকে দেখিয়েছেন। তবে তার এক ছেলেও রয়েছে। তাকে নির্ভরশীল হিসেবে দেখানো হয়নি।
শামীম ওসমানের স্ত্রী নারায়ণগঞ্জ মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান সালমা ওসমান লিপির ব্যবসা ও শেয়ার সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানতের সুদ খাতে আয়ের পরিমাণ ৬১ লাখ ১০ হাজার ৯৩৯ টাকা। একই খাতে শামীম ওসমানের আয়ের পরিমাণ কম। তার এই খাতে আয় ৫২ লাখ ৫৫ হাজার ৪৯৩ টাকা। ৫ বছর আগে তার স্ত্রীর একই খাতে আয় ছিল ৩৯ লাখ ৩৪ টাকা।
একই খাতে শামীম ওসমানের কন্যার আয় ২১ লাখ ৬৯ হাজার ৩৯ টাকা। ৫ বছর আগে সংসদ নির্বাচনের সময় দাখিল করা হলফনামায় শামীম ওসমানের কন্যার কোন আয় দেখানো হয়নি।
শামীম ওসমানের স্ত্রীর পিতা থেকে প্রাপ্ত ১৫ শতাংশ জমি ব্যতীত কোন স্থাবর সম্পত্তি নেই বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নগদ, ব্যাংকে রাখা অর্থ, স্থায়ী আমানত, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ারসহ বিভিন্ন খাতে স্ত্রীর মোট অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৬ কোটি ৮৫ লাখ ৭০ হাজার ৫০৬ টাকা দেখানো হয়েছে। যা পাঁচ বছর পূর্বে ছিল ৭ কোটি ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৫৮ টাকা ছিল।
এই খাতে শামীম ওসমান তার কন্যার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৮৩ লাখ ৮২ হাজার ৬১৬ টাকা দেখিয়েছেন। পাঁচ বছর পূর্বে কন্যার নাম সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও শামীম ওসমানের উপর নির্ভরশীলদের নামে এক কোটি ৪৪ লাখ ৫৯ হাজার ৬৩৫ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ ছিল।
উন্নয়ন: দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থান প্রকল্প, নতুন সড়ক নির্মাণ, পুরনো সড়ক উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো উন্নয়ন, ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, বন্যা দুর্গতদের আশ্রয়ণ প্রকল্প, স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা খাতসহ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় গত এক দশকে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছেন বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন সংসদ সদস্য শামীম ওসমান।