হোম রাজনীতি ভোটার আনাই চ্যালেঞ্জ: লক্ষ্য ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন

রাজনীতি ডেস্ক:

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়ায় ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করাই এখন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় দেশে-বিদেশে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে করণীয় ঠিক করছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তাদের মতে, সব রাজনৈতিক দল না এলেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে, যদি মানুষ ব্যাপক হারে ভোট কেন্দ্রে আসে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং নির্বাচন কমিশনাররা বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। গত শুক্রবার মৌলভীবাজারে এক মতবিনিময় সভায় নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, ‘ভোটারের অংশগ্রহণই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। জনগণ যদি ভোট দেয়, সেটিই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে কে এলো, কে না এলো—সেটি কিন্তু আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমাদের সঙ্গে ৪৪টি দল নিবন্ধিত আছে, নির্বাচনে অংশ নেবেন, সেজন্যই তারা নিবন্ধিত হয়েছেন। এখন কেউ যদি না আসে আমাদের কিছু করার নেই। সাধারণ মানুষ ভোট দিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক বলে গণ্য হবে।’

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি বাড়িয়ে নির্বাচন দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করতে চায় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে না এলে ভোটারদের আগ্রহে ভাটা পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিরোধী দলের বর্জনে ভোটের পরিবেশ সহিংস হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করে সাধারণ মানুষকে ভোটকেন্দ্রমুখী করাটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে কমিশনের জন্য। এ বিষয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে চায় ইসি।

তারা মনে করছে, রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত ও নির্বাচন সহিংসতামুক্ত রাখা গেলে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে পারে। সেই লক্ষ্য অর্জনে মাঠ প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই চারজন নির্বাচন কমিশনার ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ সফর করে বিভাগীয়, আঞ্চলিক ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে কঠোর বার্তা দিয়েছেন।

ডিসি-এসপিদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে গন্ডগোল ও অনিয়ম যেন না হয়। আইন ও বিধি মোতাবেক ভোট গ্রহণ করার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে কমিশনকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর চলমান আন্দোলন মোকাবিলা; অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন; নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বড় অংশের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন এড়ানো; ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো; ভোট প্রদানের হার বৃদ্ধি; সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা এবং অনিয়ম ঠেকানো। এর মধ্যে ভোটের হার বাড়ানোই অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

তবে প্রকাশ্য আলোচনায় ভোটার উপস্থিতির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না নির্বাচন কমিশন। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছে কি না, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চান তারা। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘যদি এক শতাংশ ভোট পড়ে, ৯৯ শতাংশ না পড়ে, তাহলে আইনগতভাবে নির্বাচন সঠিক। প্রশ্ন উঠবে লেজিটিমেসি নিয়ে, লিগ্যালিটি নিয়ে নয়। কাজেই লিগ্যালিটি এবং লেজিটিমেসি নিয়ে কনফ্লিক্ট আছে।’

নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান একই মনোভাব ব্যক্ত করে বুধবার কুমিল্লায় বিভাগীয় সফরে বলেছেন, ‘কত শতাংশ ভোট পড়েছে, আমার সেটা দেখবে না। নির্বাচন নির্বাচনের গতিতে চলবে। সংবিধানে কোথাও লেখা নেই কত ভোট কাস্ট হতে হবে।’

এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও উৎসবমুখর নির্বাচনে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নির্বাচনে কে এলো না এলো, সেটা বড় কথা নয়; জনগণ ভোট দিতে পারল কি না, সেটাই বড় কথা।’

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল দিল্লিতে ৯০টি দেশের প্রতিনিধিদের দেওয়া ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই, বরং পুরোপুরি উৎসবের মেজাজে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে।’

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই দেশের মানুষ অনেকটাই ভোটকেন্দ্র বিমুখ। বিএনপিসহ বেশিরভাগ দলের বর্জন করা ওই নির্বাচনে সরাসরি ভোট হওয়া ১৪৭টি আসনে ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়েছিল। ঢাকায় পড়েছিল ২২ শতাংশ। ৩০০ আসনকে হিসাবে আনলে এই হার অর্ধেকে নেমে আসবে। এরপর ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়েও বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠে। ওই নির্বাচনেও মানুষ ভোট দিতে যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় সংসদ ছাড়াও সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি অনেক কমে গেছে। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন ও সংসদের বিভিন্ন উপনির্বাচনে এমন চিত্র দেখা যায়। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ৬ আসনে গড়ে ভোট পড়ে ২৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর আগে করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে। ওই নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ছিল মাত্র ৫.২৮ শতাংশ।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ বছর অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি নির্বাচনে আগের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে যাননি। এর আগে ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৮৭.১৩ শতাংশ, যা বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ৮০ শতাংশ ভোটের হার ছিল ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। যদিও সেই ভোট নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। অতীতের নির্বাচনগুলো নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা থাকলেও এবার সেটি এড়িয়ে চলতে চায় ক্ষমতাসীনরা। সেজন্য নির্বাচন কেন্দ্র করে উৎসবমুখর পরিবেশ এবং কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে নানাভাবে তৎপর থাকবেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎসবমুখর ভোটের জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ ছাড়া কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও থাকা আবশ্যক। পছন্দের দল এবং শক্ত প্রার্থী থাকলে ভোটাররাও আগ্রহ নিয়ে ভোট দিতে যান। সেজন্য ভোটের হার বাড়াতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা প্রয়োজন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না যাওয়া মোটেও সুখকর ব্যাপার নয়। ভোটার উপস্থিতি নির্ভর করছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। বড় দল অংশ না নিলে ভোটাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এটি রাজনীতিকদেরই সমাধান করা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন বর্জনের সংস্কৃতি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে নির্বাচনই ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পথ। বড় দল অংশ নিলে এবং মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলে ভোটাররাও ভোট উৎসব করেন। সেজন্য ভোটকে উৎসবে পরিণত করতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে।’

নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম কালবেলাকে বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণ না থাকলে ভোটে মানুষের আগ্রহ কমে যায়। তারা কেন্দ্রে যায় না। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন তথা আয়োজকরা যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের নিশ্চয়তা এবং প্রশাসন ভোটের পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিধান না করে, তাহলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে চায় না। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে নির্বাচন কমিশনেরও দায় থাকে।’

এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন। নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা ৮৫২।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন