অনলাইন ডেস্ক:
সাতক্ষীরা পৌরসভার রাজারবাগান এলাকার জাবের আলী। পৈতৃক সূত্রে ১১ একর কৃষি জমি পেয়েছিলেন। তিনি মৃত্যুর সময় ৩ছেলে ৫মেয়ে রেখে যান। তার মৃত্যুর পর ছেলে-মেয়েরা অধিকাংশ কৃষি জমি বিক্রি করে দিয়েছেন এবং অনেকে কৃষি জমিতে ঘর নির্মাণ করেছেন। তাদের কৃষি জমির পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ১একরের কাছাকাছি। মাত্র ১৫বছরে ব্যবধানে এই পরিবারের ৯ একর কৃষি জমি কমেছে। এমনিভাবে সাতক্ষীরা শহরসহ পুরো জেলা জুড়ে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ জমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে।
জেলা জুড়ে কৃষি জমিতে বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখান, মাছের ঘের, কাঁকড়া খামার গড়ে উঠার ফলে বিভিন্ন খাতে চলে যাচ্ছে কৃষি জমি। অপরিকল্পিত শিল্প কলকারখানা নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে সাতক্ষীরায় আশঙ্কাজনক হারে কমছে কৃষিজমির পরিমাণ। এছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণেই আশঙ্কাজনকভাবে কৃষি জমি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনটি এখনও প্রস্তাবিত অবস্থায় রয়েছে। আইনটির প্রাথমিক খসড়া (বিল) সবার মতামতের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আইনটি ৭বছরেও পাশ না হওয়ায় কৃষি জমি বাচানো যাচ্ছে না। দ্রুত আইনটি পাশ করার দাবী জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
যে কারণে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষি জমি:
সাতক্ষীরা জেলায় আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে ফসলি জমি। ফসলের মাঠে গড়ে উঠছে নতুন বসতি, ইটভাটা, পুকুর, মৎস্য ঘের, কাঁকড়া খামার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। প্রশাসনের অনুমোদন না নিয়েই বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ কাজে ফসলি জমিকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষি জমি থেকে মৎস্য ঘেরে রূপান্তর হচ্ছে। কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনটি প্রস্তাবিত অবস্থায় থাকার কারণে সেই সুযোগ নিচ্ছে অনেক অসাধু ভূমি খেকো। ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে কৃষি জমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। এভাবে প্রতি বছর কমে যাচ্ছে আবাদি জমি, কমে যাচ্ছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। কোনো কৃষি জমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু সাতক্ষীরায় এই আইনটি মানছেন না অনেকেই।
কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের আওতায়, সরকার দেশের সব জমির শ্রেণি নির্ধারণ করে দেবে। এতে কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, আবাসন, নদী, সেচ, নিষ্কাশন, পুকুর, জলমহাল, মৎস্য এলাকা চিহ্নিত করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় প্রতিবছর ঘূণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন, লবণাক্ততা, নগরায়ন, ইটভাটা, শিল্পকারখানা, বসতভিটা, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ ও যত্রতত্র বসতি প্রতিষ্ঠার কারণে অনেক কৃষিজমি অনাবাদি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত কারণে জেলায় অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রতিবছর অনেক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে, কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। গাছগাছালি কমে যাওয়ায় পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিসংখ্যান:
সাতক্ষীরা পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এখন কৃষি খানার সংখ্যা ৫লাখ ১৪ হাজার ৩৬৬, যাদের অধীন আবাদি জমি রয়েছে ২লাখ ৭১হাজার ৪৭০একর। ২০০৮ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী জেলায় কৃষি খানার সংখ্যা ছিলো ৪লাখ ৩৬হাজার ১৭৮, যাদের অধীন আবাদি জমি ছিলো ২লাখ ৮০ হাজার ৭৩০ একর। সেই হিসাবে ১২ বছরের ব্যবধানে সাতক্ষীরা মোট আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ৯ হাজার ২৬০ একর। অন্যদিকে কৃষি খানার বৃদ্ধি পেয়েছে এক লাখ ৬৪ হাজার ৭০৮। ২০০৮ সালের পর ২০১৯ সালে কৃষিশুমারি হয়।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ৩ হাজার ৮৫৮ দশমিক ৩৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ২২লাখ মানুষের বাস। ২৩ বছর আগে জেলায় আবাদযোগ্য জমি ছিলো এক লাখ ৭৩ হাজার ৬০৪ হেক্টর। এখন তা কমে এক লাখ ৬৫ হাজার ২৪৫ হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভুক্তভোগীদের মতামত:
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গুনাকরকাটি এলাকার আব্দুল বারী বলেন, গত ১০ বছরে আমার এলাকার ১০০ বিঘা জমি যেখানে ধানসহ অন্যান্য ফসল হতো। সেই সব জমি কৃষি খাত থেকে অন্য খাতে চলে গেছে। এছাড়া ৪০ বিঘার বেশি জমি ঘর-বাড়ি স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরীতে চলে। এমনিভাবে প্রতিবছর কৃষি খাতের জমি অন্যখাতে চলে যাচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে খাদ্যের উপর চাপ পড়বে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী জাওহার দুদায়েভ স্নাতক পর্যায়ে গবেষণা করেছেন উপকূলীয় কৃষিজমির হ্রাস নিয়ে।
ল্যান্ডস্যাট ৪-৫, ল্যান্ডস্যাট ৮এবং সেন্টিনেল ২ স্যাটেলাইটের মোট ৭টি চিত্রের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে তিনি দেখেছেন, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নে গত ৩০ বছরে মোট কৃষিজমির শতকরা ৮৪ভাগের অধিকাংশই ঘের এবং আংশিক বৃক্ষহীন জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ।
গাবুরার বিভিন্ন ওয়ার্ডে নদী, ঘের এবং সুপেয় পানির উৎসের লবণাক্ততা পরীক্ষা করে তিনি পেয়েছেন- প্রায় সকল ওয়ার্ডেই নদী এবং ঘেরের পানির মাঝে সাদৃশ্য বিদ্যমান। এইসকল নমুনার লবণাক্ততার মাত্রা ৬-৯ পিপিটি পাওয়া গেছে। অপরদিকে বিভিন্ন ওয়ার্ডের সুপেয় পানির নমুনা ০ (শূন্য) পিপিটি (লবণাক্ততা অনুপস্থিত) হলেও ৭ এবং ৮নং ওয়ার্ডের নমুনায় লবণাক্ততার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সাতক্ষীরা উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. বাবুল আক্তার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-উপকূলীয় এলাকায় দিন দিন লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া অসময়ে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, জলমগ্ন হয়ে পড়ছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মার্চ-এপ্রিলের পর থেকে ১৬-১৮ ডিএস মিটার লবণাক্ততা দেখা গেছে। এপ্রিলের আগে ১০-১২ ডিএস মিটার লবণাক্ততা পাওয়া যায়। উপকূলীয় এলাকায় ৮ডিএস মিটারের নিচে কখন নামে না। এতে করে কৃষি চাষের আওতায় জমি কমে যাচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, আবাসন ও শিল্প উন্নয়নের কারণে জেলায় কৃষি জমির পাশাপাশি জলাশায়ও কমে যাচ্ছে। পুকুরগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে তিনি নিজের একটি বাড়ি তৈরী করছেন। এতে করে জমি কমে যাচ্ছে। একটি পরিবারের পাঁচ ভাই থাকলে তারা যদি ৩কাঠা করে জমি ব্যবহার করে তাহলে ১৫ কাঠা জমি লাগে। সেই জমি অধিকাংশ কৃষি জমি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কৃষি জমি রোধে সকল ভাই মিলে ৫তলা একটি বাড়ি করলে আমাদের কৃষি জমি বেচে যেতে। একটি বাড়িতেই সকলের চাহিদা মিটে যেত। বাকি জমি চাষবাদ করে সকলের পারিবারিক ফসল ও সবজির চাহিদা মিটে যেত। অনেকের সামর্থ্য থাকে না তাদের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে আবাসনের জন্য সহজ শর্তে লোনে ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারিভাবে নির্দেশনা দিতে হবে কৃষি জমি কোনভাবেই নষ্ট করা যাবে না। তাহলে আমাদের কৃষি হ্রাস ও জলাশয় ভরাট অনেক অংশে কমে যাবে।
তিনি আরও বলেন, পৌরসভার অধিকাংশ পুকুর খতিয়ানে ডাঙ্গা হিসেবে দেখানো। তারা যখন পুকুর ভরাট করে তখন এটি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর এই বিষয়ে কিছু করতে পারছে না।
তবে আমরা শিল্প কারখানার ক্ষেত্রে ছাত্রপত্র দিলেও জোরালোভাবে দেখছি সেটা কৃষি জমি কিনা। যেখানে দুই ফসল হয় সেখানে কোনভাবেই শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ছাড়পত্র দিচ্ছি না। বিসিকের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি। প্লটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শিল্প উদ্যোক্তদেরও বলছি আমরা পাশে না বাড়িয়ে উপরের দিকে বাড়ান। বিষটি নিয়ে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাবতে হবে। বর্তমান বাড়ির তৈরীর ক্ষেত্রের ঋণ দেওয়ার সময় ব্যাংকগুলোর তদন্ত করে দেখা উচিত বাড়িগুলো কিভাবে তৈরী করছে। কৃষি জমি নষ্ট করলে তাদের ঋণ দেওয়া ঠিক হবে না। এখনই ব্যবস্থা না নিতে পারলে সামনে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
তিনি আরও বলেন, সাতক্ষীরা পৌরসভায় অপরিকল্পিতভাবে ভবন তৈরী হচ্ছে। কেউ নকশার অনুমোদন নিচ্ছে না। কোন আইনের প্রয়োগ নেই। অনেকে অনুমতি নিচ্ছে নকশাতে এক রকম দেখাচ্ছে বাস্তাবে সেটা মানছে না। নকশা অনুযায়ী হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে পৌরসভা তদারিক করছে না। তাদের সেই রকম লোকবলও নেই। এসব জায়গার লোকবল বাড়াতে। না হলে সমস্যা থেকেই যাবে।
জলবাযু পরিষদ সাতক্ষীরার সদস্য সচিব অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, বিগত কয়েক বছরে সাতক্ষীরার অনেক কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। সাতক্ষীরা বাইপাস সড়কের পাশের অনেক কৃষজমিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গড়ে উঠার মাধ্যমে অনেক কৃষি জমি নষ্ট হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় বুড়িগোয়ালীনিসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে বিভিন্ন মাছ ও কাঁকড়ার প্রসেসিং প্লান্ট গড়ে উঠার মাধ্যমে অনেক কৃষি জমি হারিয়ে গেছে। শ্যামনগর উপজেলার ১০শতাংশ কৃষিজমি মৎস্য চাষে চলে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজতিন কারণে উপকূলীয় এলাকার অনেক মানুষ এখন শহরমুখী হচ্ছে তারা এখানে এসে জমি কিনে বাড়ি ঘর তৈরী করছে সে কারণে শহর এলাকায় দ্রুত কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কৃষি জমি বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে প্রধানত কয়েকটি কারণে। কৃষকের দূরদর্শিতার অভাব, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ভূমিদখলবাজ অসাধু ইটভাটা মালিকদের আগ্রাসন। এছাড়া নগরায়ন, শিল্পায়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস, দূষণ, লবণাক্ততা, মরুকরণ নানা কারণে জেলার কৃষি জমি আজ হুমকির সম্মুখীন।
তিনি বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন অনুযায়ী কৃষি জমি নষ্ট করে বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা এবং অন্যান্য অকৃষি স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু অনেক ল্যান্ড প্রপার্টিজ গ্রুপ কৃষি জমিতে কম দাম কিনে প্লট আকারে বিক্রি করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ নেই। সে কারণে দিন দিন কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। আগামী দিনে আমাদের খাদ্যে উৎপাদনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে তেমিনভাবে পরিবেশের উপরও মারত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। হুমকিতে পড়বে জীববৈচিত্র।
মানাবাধিকারী কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে মানুষের নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। বিশেষত, নারী ও শিশুদের চলচলে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। অপরিকল্পিত শহর গড়ে উঠার ফলে শিশুদের মনোবিকাশে কোন ব্যবস্থা নেই, নেই কোন খেলার মাঠ, পার্ক এবং শিশু বিষয়ক কোন পাঠাগার। ফলে একটি বন্ধা সমাজ তৈরী হচ্ছে যেখানে মানবাধিকার বলে কিছু থাকছে না।
এ বিষয়ে যথাযথ কর্তপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, অবশ্যই নগরায়নের পূর্বে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে একটি পথনকশা অনুমোদন করিয়ে নেওয়া উচিত। যা পরিকল্পিত নগর গঠনে সহায়ক হবে এবং সরকারের টেকসই উন্নয়ন তথা এসডিজি নিশ্চিত হবে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় সেটা লক্ষ্যে উন্নয়ন ত্বরান্বীত হবে। ভূমি হারানোর ফলে কৃষক কাজ হারাচ্ছে, হারাচ্ছে তার অর্জিত লোকায়াত জ্ঞান। যার ফলে সে বিকল্প পেশা খোঁজার চেষ্টা করছে। কৃষক থেকে দিন মজুর হিসেবে পরিণত হচ্ছে এবং দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম অবস্থানে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে অবশ্যই সরকারকে অষ্টম পঞ্চম বার্ষিকীর পরিকল্পনার আলোকে টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক এড. আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন হওয়ার হওয়ার কারণে এবং সরকারি নীতিমালা না মেনে ঘরবাড়ি, মিল কলকারখানা হওয়ার কারণে কৃষি খাতের জমিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরা শহর এবং উপকূলীয় এলাকায় কৃষি খাতের অনেক জমি জলাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে। অনেক জমি ১২মাস পানি বন্ধি হয়ে থাকে এবং পানি সরানের কোন ব্যবস্থা নেই। সে কারণেও অনেক কৃষি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষি জমিতে ঘের হচ্ছে। যে মৎস্য ঘেরগুলো হওয়ার কথা ছিলো সারাবছর যে জমিগুলোতে পানি থাকে সেই জমিতে কিন্তু হচ্ছে তার উল্টো। যেখানে ধানসহ অন্যান্য ফসল ফলানো সম্ভব সেখানে হচ্ছে মাছের ঘের। উপকূলের পাশাপাশি সাতক্ষীরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টি পানির এলাকায় লবণ পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি মাছ চাষ করা হচ্ছে। পরিকল্পনা ও জবাদিহীতার অভাবে প্রতি বছর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। গাইড লাইনের মধ্যে আনার জন্য সরকারের দাবী করছি। তা না হলে সামনে কৃষিজমি কমে যাওয়ায় খাদ্য উৎপাদনসহ সমাজজীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
তিনি আরও বলেন, কৃষিজমি সুরক্ষার যে আইন আছে সেই আইন কেউ মানছে না। ২০১৫ সালে কৃষিজমি সুরক্ষায় সংক্রান্তটি আইনটি এখনও প্রস্তাবিত অবস্থায় আছে। এটির খসড়া প্রস্তুত করা হলেও এখনও পাশ হয়নি।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০০১ সালে জেলায় আবাদযোগ্য জমি ছিলো এক লাখ ৭৩হাজার ৬০৪হেক্টর সেটা ২০১০-১১ সালে এসে দাঁড়ালো এক লাখ ৭০হাজার ৪১৯ এবং ২০২২-২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী এক লাখ ৬৫হাজার ২৪৫ হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। জেলায় কৃষি জমি বাড়ি-ঘর রাস্তাঘাট, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখান মৎস্য ঘেরসহ বিভিন্ন খাতে চলে যাচ্ছে। আরার ঘের থেকে অনেক জমি কৃষি খাতে আসছে। এমনিভাবে প্রতি বছর কৃষি খাতের জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কৃষি জমি কমে যা কারণে একটু সমস্যা হয়। তবে আমাদের এখানে খাদ্য উৎপাদনের খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না। ফলন বেশি করার জন্য কৃষি বিভাগ থেকে লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন, নিবিড় ফসল চাষসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে এগুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি।
তিনি আরও বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষায় সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়া জেলা সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে কৃষি জমি অন্যখাতে চলে গেলে আমি তাদের অবহিত করি। এই কমিটির মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
আইনে যা বলা হয়েছে:
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওসমান বিন নাসিম বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষা আইনটি এখনও প্রস্তাবিত অবস্থায় আছে। এটি ২০১৫ সালে সালে খসড়া প্রস্তুত করা হয়। আইনটির প্রাথমিক খসড়া (বিল) সবার মতামতের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত আইনি পাশ হয়নি। এই আইনের মাধ্যমে কৃষি জমির সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে যেসকল কৃষি জমিতে একবার বা দুইবার ফসল উৎপাদন হয় অথবা চাষাবাদের জন্য ব্যবহৃত হয়। সেই জমি কোনভাবে অকৃষি খাতে ব্যবহার করা যাবে না। প্রতিবছর ৫৫০হেক্টর কৃষি জমি বিলীন হয়ে ঘর বাড়িতে রূপান্তর হয়ে যাচ্ছে। এটা ঠেকাতেই এই আইন করা হয়েছে। এখানে আরও অনেক সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। কোন কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান কৃষি জমি কিনে তারা শিল্প কলকারখানা তৈরী করতে না পারে সেজন্য বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনের ১২ধারায় বলা হয়েছে যে, ৪, ৫, ৬, ৯, ১০ ধারা উল্লিখিত বিধানসমূহ ভঙ্গ করলে উক্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীগণ অনূর্ধ্ব ৫বছরের কারাদন্ড বা সর্বনি¤œ ১লক্ষ টাকা জরিমান বা উভ দন্ডে দ-িত হবেন। ধারা ৪ এ বলা হয়েছে বাংলাদেশে যে পরিমাণ কৃষি জমি আছে তা এই আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। সরকার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ম্যাপ, ভূমি জোনিং অনুসারে বসত বাড়ি, উন্নয়নমূলক কাজ বা শিল্প কারখানা নির্মাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত অনুউর্বর জমি ব্যবহার করতে হবে। কোন ব্যক্তি কৃষি জমি ক্রয় করে জমিকে পরিবর্তন করতে পারবে না, কৃষি কাজেই উক্ত জমি ব্যবহার করতে হবে (ধারা-৪)।
সরকার কর্তৃক ঘোষিত বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্বলিত যেমন চা বাগান, ফলের বাগান, রাবার বাগান, জলাভূমি, টিলা বা পাহাড় শ্রেণী ইত্যাদির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ভূ-প্রকৃতিগত কোন পরিবর্তন করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, এটি পাশ না হওয়ার পিছনে কিছু কারণ আছে তা হচ্ছে- দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বড় বড় কোম্পানিগুলো কৃষি জমিতে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলেন। এই আইন পাশ হলে তাদের কিছুটা বেকায়দায় পড়ে যাবেন। এই আইনটি শিল্পয়নের জন্য বড় বাঁধা। এই আইনটি পাশ হলে গায়ের জোরে ভূমি দখল বন্ধ হবে। আইন বিশেষজ্ঞরা এটি দ্রুত কার্যকরের দাবী জানিয়েছেন এবং এটির সঠিক প্রয়োগ হলে কৃষি জমি সুন্দর একটি ব্যবস্থাপনার অধিনে আসবে তারা মতামত দিয়েছেন।
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিষ্ণুপদ পাল বলেন, ইটভাটা করতে গেলে কৃষি বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কোনভাবেই কৃষি জমিতে ইটভাটা করার অনুমতি দেওয়া হয় না। কৃষি জমিতে ইটভাটা, পুকুর খনন বা মাছের ঘের তৈরীর খবর শুনলেই তাদের বিরুদ্ধে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি।