বাংলাদেশে যোগাযোগ খাতের বিস্ময়কর এক প্রতীক পদ্মা সেতু। গেলো বছরের ২৫ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর ২৬ জুন সেতুটি খুলে দেয়া হয় যানবাহনের জন্য। আর সব কাজ শেষে এখন প্রস্তুত সেতুর রেলওয়ে অংশ। মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) পরীক্ষামূলকভাবে একটি ট্রেন পাড়ি দেবে সেতুটি।
এরইমধ্যে পদ্মা সেতুতে শেষ হয়েছে ৬.১৫ কিলোমিটার পাথরবিহীন রেলপথ নির্মাণকাজ। এদিন (৪ এপ্রিল) পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন থেকে মাওয়া স্টেশন পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার রেলপথে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালানো হবে। এর মাধ্যমে সম্পন্ন হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু জয়ের বাকি উপাখ্যানও।
গত বছরের ২০ আগস্ট সেতুতে রেললাইন স্থাপন কাজের উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তবে বিভিন্ন জটিলতায় পুরোদমে কাজ শুরু হয় নভেম্বরে। এরকাজ শেষ হলো পঞ্চম মাসে এসে। এখন শুধু ট্রেন চলার অপেক্ষা।
মঙ্গলবার রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন নিজে যাত্রী হয়ে পরীক্ষামূলক ট্রেনে পাড়ি দেবেন পুরো পদ্মা সেতু।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প – পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। যাতায়াত আর বাণিজ্যের নতুন দ্বার খুলে দেয়া এ রেলপথের অপেক্ষায় পুরো বাংলাদেশ।
গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন থেকে দোতলা সেতুর ওপর দিয়ে সড়কে শুরু হয় যান চলাচল। লক্ষ্য ছিল পদ্মা সেতুতে একই দিনে ট্রেন চলাচলও শুরু করার। কিন্তু বাংলাদেশ সেতু বিভাগের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের সমন্বয়ের অভাবেই মূলত পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন চালানো সম্ভব হয়নি।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, ঢাকা থেকে মাওয়া অংশের পুরো কাজ শেষ হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তারপর ঢাকা থেকে ভাঙ্গা অংশে ট্রেন পরিচালনা সম্ভব হবে। এখন মাওয়া থেকে পদ্মা বহুমুখী সেতু হয়ে ভাঙ্গা অংশে পরীক্ষামূলকভাবে বিশেষ ট্রেন পরিচালনার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যদিয়ে প্রথমবারের মতো পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন পরিচালনা করা হবে। তারও আগে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে শরীয়তপুরের পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথে একটি ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনা করা হয়েছিল।
এ রেল সংযোগ প্রকল্পের মধ্যদিয়ে ঢাকা-যশোর-খুলনার মধ্যে ২১২.০৫ কিলোমিটার সংক্ষিপ্ত রুট এবং উন্নততর পরিচালন সুবিধার বিকল্প রেলপথ স্থাপিত হবে।
পদ্মা রেলসেতু ৭ খণ্ডে বিভক্ত
দেশে প্রথমবারের মতো সর্ববৃহৎ রেলব্রিজ মুভমেন্ট জয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে পদ্মার রেলসেতুতে। এতে দ্রুতগতির রেল চলাচলের সময় এ জয়েন্টে রেললাইন ৮০০ মিলিমিটার পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারবে। পদ্মা রেলসেতু ৭ খণ্ডে বিভক্ত। আর সেতু টেকসই রাখতে নকশা অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্বে বিভাজন রাখা হয়েছে। তাই মূল সেতুর সঙ্গে দুই প্রান্তের ভায়াডাক্টের সংযোগ এবং মাঝে জয়েন্ট আছে ছয়টি। কংক্রিটের পাথরবিহীন রেললাইনের সঙ্গে যুক্ত করতে এ জয়েন্টগুলো স্টিল দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি। পুরো সেতুতে ১০ হাজার ৭৯০টি স্লিপার বসেছে।
চারটি ধাপে ছয় বেয়ারিং প্লেট ছাড়াও সাতটি প্লেটের ওপর স্থাপিত শক্তিশালী এ মুভমেন্ট জয়েন্ট। ব্যতিক্রমী একেকটি জয়েন্টের ওজন প্রায় ১৫ টন। আর মূল সেতুতে ১১ হাজার ১৪০টি স্লিপার স্থাপিত হয়েছে। মুভমেন্ট জয়েন্টের ইস্পাতের ৮টি স্লিপার ছাড়া বাকি সব কংক্রিটের তৈরি। এগুলো ফরিদপুরের ভাঙ্গা পুরনো রেলস্টেশনের পাশে স্থাপিত কারখানায় তৈরি করেছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের ১৭২ কিলোমিটার রেললাইন তৈরির জন্য সব স্লিপার একই কারখানায় তৈরি হয়েছে। তবে বিশেষ তাপমাত্রায় মুভমেন্ট জয়েন্টের ইস্পাতের স্লিপারগুলো তৈরি করে আনা হয়েছে চীন থেকে।
প্রকল্পের মোট ১৭২ কিলোমিটার লেভেল ক্রসিংবিহীন রেলপথে ৩২টি রেল কালভার্ট, ৩৭টি আন্ডারপাস এবং ১৩টি রেলসেতুর কাজ শেষ হয়েছে। সেতুর দুই পাশের স্টেশন নির্মাণ চূড়ান্ত পর্যায়ে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কন্সট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্টের (সিএসসি) তত্ত্বাবধানে চলছে পদ্মা সেতুর এ রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজ। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন।
বাঁচবে সময়
পদ্মা সেতু চালুর পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। রেল সংযোগ প্রকল্প পুরো শেষ হলে রেলসেবার আওতা আরও বাড়বে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা করছেন, রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঢাকা-যশোর ট্রেনে চলাচল করা যাবে দুই ঘণ্টারও কম সময়ে। এটা বাস্তবায়ন হলে সংশ্লিষ্ট যাত্রীদের সময় বাঁচবে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ এখন এগিয়ে যাচ্ছে ধাপে ধাপে। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা থেকে খুলনায় রেলপথের নতুন পথ তৈরি হবে। নতুন এ রেলপথে যাতায়াতে রাজধানী ঢাকা থেকে খুলনার দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার। ঢাকা-খুলনা যাতায়াতে লাগবে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা। প্রকল্পের অধীনে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত নতুন ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক করিডোরের মূলকেন্দ্র
পদ্মা সেতু হয়ে ওঠছে দেশের অর্থনৈতিক করিডোরের মূলকেন্দ্র। অর্থনেতিক মুক্তির অনন্য প্রতীক হয়ে ওঠবে এ পদ্মা সেতু। একে মূল কেন্দ্রে রেখে সড়ক ও রেলের এ সংযোগ আঞ্চলিক নয়, আন্তর্জাতিক সংযোগও বটে। আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগে, বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তির বাস্তবায়নে এ সেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ট্রান্স-এশিয়ান রেল ও সড়ক এ সেতুর মাধ্যমেই যুক্ত হবে।
পদ্মা রেলসেতু চালু হওয়ার ফলে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ২১ জেলার সঙ্গে অন্যান্য বিভাগের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এবং মাঝারি শিল্পের পণ্য পরিবহনে সময় ও অর্থ কম লাগবে, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করবে। এরই মধ্যে সড়কপথে এর সুফল পেতে শুরু করেছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।
জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদি এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কাজ করছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্যদিয়ে এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন অনেকটা হাতের কাছে চলে এসেছে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৩ কোটি মানুষ উপকৃত হওয়ার স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে আরও নানান শিল্প ও পর্যটনকেন্দ্র। এসব সারা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করবে। এতে রেল সংযোগ প্রকল্পের থাকবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ বহুল প্রত্যাশার প্রকল্প। বলা হচ্ছে, এ রেলপথে ট্রেন চলবে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে। দেশে পাথরবিহীন (ব্যালাস্ট) এ রেলপথটি হচ্ছে প্রথমবারের মতো। এ রেলপথে ট্রেনের গতি ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যবস্থাপনা যেন জোরদার থাকে, সেদিকে বাংলাদেশ রেলওয়েকে সব সময় সজাগ থাকতে হবে।