রাজধানীর রমনা থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের জামিন দিয়েছেন আদালত। আজ সোমবার (৩ এপ্রিল) ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূর এই আদেশ দেন।
এর আগে আজ সোমবার সকালে ঢাকার সিএমএম আদালতে আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার জামিনের আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুপুরের পরে এ সংক্রান্ত জামিন শুনানি শেষ হয়। এরপরে ৩টার দিকে বিচারক ২০ হাজার টাকা মুচলেকায় পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল পর্যন্ত জামিনের আদেশ দেন।
শুনানিতে আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, আসামির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। এছাড়া এ মামলার এজাহারে বর্ণিত ঘটনা, অর্থাৎ প্রতিবেদনটি করা হয়েছে দিনমজুর জাকির হোসেন এবং সবুজ নামের প্রথম শ্রেণির একজন ছাত্রের বক্তব্য দিয়ে। এটিতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। এখানে দেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়নি।
আইনজীবী শুনানিতে আরও বলেন, ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ছবির সঙ্গে দিনমজুর জাকির হোসেনের বক্তব্য ছিল, তা প্রথম আলোর কাছে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়ায় প্রথম আলো নিজ উদ্যোগে তা প্রত্যাহার করে নেয়। দুঃখ প্রকাশ করে, ক্ষমা চায়। পরে সংশোধনী আকারে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। কোনো মিথ্যা তথ্য দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে রিপোর্ট করা হয়নি।
অপরদিকে, রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করে শুনানি করেন মহানগর পিপি আব্দুল্লাহ আবু।
প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে গত ২৬ মার্চ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনের কিছু উদ্ধৃতি নিয়ে একটি গ্রাফিক্যাল কার্ড তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশ হয়। ওই কার্ডে একটি শিশুকে ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। জাকির হোসেন নামে একজনের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই কার্ডে লেখা হয়, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়ে কী করুম? বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’
এই বক্তব্য নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। পরে একাত্তর টিভির একটি প্রতিবেদনে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সাজানো বলে দাবি করা হয়। শিশুটির বরাতে বলা হয়, ‘প্রথম আলোর সাংবাদিক তার হাতে ১০ টাকা দিয়ে এ ছবি তুলেছে।’
প্রথম আলো দাবি করে, ‘পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় ছবি এবং উদ্ধৃতির মধ্যে অসঙ্গতির বিষয়টি তাদের নজরে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে কার্ডটি সরিয়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি সংশোধনও করা হয়। এরপর সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখ করে পরে তা আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। তারা দাবি করে, ‘প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি ওই উদ্ধৃতিটি ওই শিশুর। তারা উল্লেখ করে, প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের।’
এর দুদিন পর ২৯ মার্চ ভোরে সাভারের বাসা থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্য পরিচয়ে শামসুজ্জামানকে তুলে নেওয়া হয়। এদিন মধ্যরাতে তার বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। অ্যাডভোকেট আবদুল মশিউর মালেকের ওই মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, পত্রিকাটির সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস, সহযোগী একজন ক্যামেরাম্যান ও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। তার আগে তেজগাঁও থানায় সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া নামে এক যুবলীগ নেতা বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরও একটি মামলা করেন।
এ ঘটনায় ৩০ মার্চ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘স্বাধীনতার দিনটি আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করি। সেই দিন তথ্যভিত্তিক নয়—এমন সংবাদ প্রকাশ করে একটি পত্রিকা। যেভাবে বাংলাদেশ এগিয়েছে, সেটাকে কটূক্তি করে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেজন্য পুলিশের একটি দল সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিলেও এ ঘটনায় সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা হচ্ছে, কয়েকটি মামলা ইতোমধ্যে হয়েছে। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, ‘মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা হয়েছে, সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে নয়।’
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ২৬ তারিখ অনলাইনে (প্রথম আলোর) যে সংবাদটি পরিবেশন করা হয়েছে, এটি অবশ্যই রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে। স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে…, জাতীয় স্মৃতিসৌধ আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, সেখানে একটা ছেলেকে ১০ টাকা দিয়ে ফুঁসলিয়ে তাকে দিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সে যেটি বলেনি সেটি প্রচার করা হয়েছে। এটি ঠিক হয়নি বলেই তো তারা (নিউজ) সরিয়ে নিয়েছে। এখানে অবশ্যই রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে।’
এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি ‘পলিটিক্যালি মোটিভেটেড’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘নবীনগরে একটা বাচ্চার হাতে ১০ টাকা দিয়ে স্বাধীনতা নিয়ে তার মন্তব্য নেওয়া হয়েছে। ছেলের নাম সবুজ। তাকে বানানো হয়েছে জাকির হোসেন। ছেলে স্কুলের ছাত্র, তাকে বানানো হয়েছে দিনমজুর।’