অনলাইন ডেস্ক :
মানুষ আর প্রকৃতি যেন পাল্লা দিয়ে নেমেছে ধ্বংসযজ্ঞে। একদিকে যুদ্ধের দামামা অন্যদিকে লাগাতার প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত সৌরজগতের একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ পৃথিবী।
মহামারি কিংবা বিশ্বযুদ্ধ মানবসভ্যতায় নতুন কিছু না। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে চিকিৎসাখাতে উন্নতি ও মানুষের সভ্যতার বিকাশের হিসেব থেকে বলা হচ্ছিল, অন্তত মানুষ আর মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না।
কিন্তু গত দুই বছরের কাণ্ডকারখানা সারা পৃথিবীকে এটাই জানান দিয়েছে- মানুষকে ধ্বংস করতে মানুষের কার্যক্রমই যথেষ্ট।
করোনা বাদুর থেকে এসেছে নাকি ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে- এসব প্রশ্নের উত্তরের থেকে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়া বিশ্বকে এক রকমের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নাজেহাল করে রেখেছে করোনা। এখন পর্যন্ত এই রোগে সারা বিশ্বে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৬৮ লাখ মানুষ।
করোনার ঘা শুকানোর আগেই যুদ্ধের দামাম বাজাল রাশিয়া। প্রায় এক বছর ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সারা বিশ্ব এক রকমের দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদল পশ্চিমাদের পক্ষে, অন্যদল সাবেক সোভিয়েতের সঙ্গে। এর ওপরে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার চলমান উত্তেজনা বিশ্ব বাজারে সৃষ্টি করেছে নতুন গোলোযোগ।
করোনার পর বিশ্ব বিনির্মাণে সবার যেখানে একাট্টা থাকার কথা সেখানে আধিপত্যের লড়াইয়ে বিভক্ত পুরো বিশ্ব। করোনার সময়ে গবেষকরা বলেছেন, এই শেষ নয়। পরের মহামারি ও দুর্যোগগুলো হবে আরও ভয়াবহ। আগামী বিশ্বের বড় সংকটের কারণ হবে জলবায়ু পরিবর্তন।
ক’বছর আগেও সাধারণ মানুষের কাছে জলবায়ু ছিল এক রকমের উপেক্ষার বিষয়। বিশ্বপ্রকৃতিকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করেছে মানুষ। শিল্প বিপ্লবের নামে পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতায় পয়সা কামানোর চক্রে হুমকির মুখে ফেলেছে পৃথিবীকে। এখন বয়সের আগেই বুড়িয়ে গেছে পৃথিবী। পৃথিবীর পৃষ্ঠে থাকা মানব সন্তানেরা প্রমাদ গুনছে আগত কোনো মহা দুর্যোগের।
একদিকে প্রকৃতির প্রতিশোধ অন্যদিকে মানুষের প্রতিহিংসায় দিনকে দিন বাড়ছে নানামুখী প্রতিকূলতা। যেখানে একাট্টা হয়ে মানুষের কাজ করার কথা জলবায়ু রক্ষায় সেখানে মানুষ ব্যস্ত বন্দুকের ঝনঝনানি ও বোমারু বিমান নিয়ে রক্ত পিপাসা মেটাতে।
এ দিকে একদল পরিবেশবাদী মানুষ বারবার বধিরদের কানে ঘণ্টা বাজিয়ে জানান দেয়ার চেষ্টা করছেন, সামনে মহাবিপদ। একযোগে কাজ করতে হবে। কিন্তু প্রতিহিংসা ও পয়সা কামানোর ধান্ধায় যারা আজ বধির সেজে আছে তাদের কানে যে এ পাগলা ঘণ্টার আওয়াজ পৌঁছাবে না তা সহজেই অনুমেয়।
বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর জলবায়ু ও পরিবেশ একটি কিম্ভুতকিমাকার ‘ডুম লুপ’ এর মধ্যে আছে। ডুম লুপ হচ্ছে সেই চক্র যেখানে একটি নেতিবাচক কাজের প্রভাবে আরেকটি নেতিবাচক ঘটনা ঘটে। সেটির প্রভাবে আবার আরেকটি। এভাবে চক্রাকারে ধ্বংসযজ্ঞের শেষ সীমায় না যাওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে এ চক্র। গার্ডিয়ান যে অত্যুক্তি করেনি তার প্রমাণ বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
এশিয়ার দেশগুলোতে সমানুপাতিক হারে খরা ও বন্যার আঘাত, পশ্চিমা দেশগুলোতে দাবানল ও ঘূর্ণিঝড়, আফ্রিকার খরা ও নানা রোগের আঘাত আর যখন তখন ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠা পৃথিবী বারবার অশনী সংকেত দিচ্ছে মানব সভ্যতাকে।
কিন্তু মানুষ যেন সেই খরগোশ, যে ঈগলের থাবা থেকে বাঁচতে চোখ বুজে কল্পনা করে নেয়- তার পেছনে আসলে কোনো ঈগলই ধাওয়া করছে না। আক্রান্ত হবার পরে, মানুষ হয়ে যায় সেই গল্পের ব্যাঙ যে গরম পানিতে পরে লাফ দিয়ে বের হবার বদলে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করে ও শেষমেশ বাধ্য হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ভাবে- এই ছিল বোধহয় নিয়তিতে।
বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশগুলো পরিবেশ সংক্রান্ত নানা সম্মেলন করেও জলবায়ুতে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারেনি। সারা বিশ্বের তাপমাত্রা মাত্র দেড় ডিগ্রি কমানোর লক্ষ্য পূরণ হয়নি। হবেও বা কীভাবে- সম্মেলনের সিদ্ধান্ত থেকে যায় কাগজে কলমে। সারারাত রামায়ণ শুনে রাষ্ট্রপ্রধানরা দেশে ফিরে বলে- সীতা কার বাপ?
সম্প্রতি ইনস্টিটিউট ফর পাবলিক পলিসি রিসার্চের (আইপিপিআর) গবেষক লরি লেবর্ন জানান, জলবায়ু সংকটের নতুন এক মাত্রায় প্রবেশ করেছে সারা বিশ্ব। টেবিল চাপড়িয়ে বক্তৃতা দেয়ার দিন শেষ। হয় এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নইলে ফল ভোগ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ছে, গলছে অ্যান্টার্টিকার বরফ। এখন দোষারোপের সময় নয়, সময় একাট্টা হয়ে সংকট সামাল দেবার। প্রতিটি মানুষকে বুঝতে হবে জলবায়ু সংকট সামাল দিতে তাদের সবার কিছু না কিছু করার আছে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য বৈশ্বিক থেকে প্রান্তিক প্রতিটা অঙ্গনে সবাইকে সচেতন হতে হবে, দেখাতে হবে সদিচ্ছা ও জলবায়ু রক্ষায় থাকতে হবে সোচ্চার।
এত সব সংকটের মধ্যে খারাপের ভালো ও এক টুকরো আশার আলো হচ্ছে, পশ্চিমাদের বোধদয় হয়েছে, নিজের জ্বালানি নিজেদেরই জোগাতে হবে। এর জন্য গ্রিন এনার্জিতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমারা। এ বছর শীতের প্রকোপ কম থাকা পশ্চিমাদের জন্য তাৎক্ষণিক আশীর্বাদ হলেও, দীর্ঘমেয়াদে পুরো বিশ্বের জন্য এটি বিপদ সংকেত। তাপমাত্রা বাড়ছে মানে উত্তর মেরুর বরফ আরও বেশি করে গলছে। পৃথিবীর একাংশ তলিয়ে যাওয়ার সেই সংকটময় মুহূর্ত ত্বরান্বিত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ইকনোমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপরে নির্ভরশীলতা কমাতে নিজেরাই গ্যাস ও বিদ্যুতের জোগান দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী পাঁচ-দশ বছরে গ্রিন এনার্জিখাতে বিনিয়োগ বাড়বে উল্লেখযোগ্য হারে। এতে করে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি কমানোর লক্ষ্য যে এখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়নি তারই আশা দেখছে সচেতন মানুষ।
বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক সভায় মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, যেভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এতে করে বড় রকমের সংকটের দিকে এগোচ্ছে পৃথিবী। চলমান অভিবাসন সমস্যার মধ্যে জলবায়ুর প্রভাবের পৃথিবীর একাংশ তলিয়ে গেলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে ৯০০ মিলিয়ন মানুষ। বিশেষ করে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো বড় রকমের বিপদে পড়বে বলে মন্তব্য করেন গুতেরেস।
নগর পুড়লে যেমনি দেবালয় এড়ায় না, তেমনি উপকূল ডুবে গেলে এর প্রভাব পড়বে বড় বড় শহরগুলোতে। শঙ্কার মধ্যে থাকা শহরগুলোর নাম উল্লেখ করে গুতেরেস জানান, ঢাকা, ব্যাংকক, জাকার্তা, মুম্বাই, সাংহাই, কোপেনহেগেন, লন্ডন, লস অ্যাঞ্জেলস, নিউইয়র্ক, বুনো আরিস ও সান্তিয়াগোর মতো বড় শহরগুলো জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুগবে।
সম্প্রতি বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) এক রিপোর্টে দেখা যায়, ১৯০০ সালের পর বিশ্বের সামগ্রিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যে পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে গত ৩ হাজার বছরেও এতটা বাড়েনি। এছাড়া বর্তমানে যে হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা গত ১১ হাজার বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। অন্যদিকে ১৯৭৯ সালের পর থেকে আর্কটিক অঞ্চলে প্রতি বছর ২০ হাজার স্কয়ার ফুট এলাকার সমপরিমাণ বরফ গলছে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
আর্কটিক অঞ্চল ছাড়াও যে হারে হিমালয়ের বরফ গলছে তাতে করে এশিয়ার অঞ্চলগুলো দ্বিমুখী বিপদে পড়বে। বিশেষ করে পাকিস্তানে সর্বশেষ হয়ে যাওয়া বন্যার একটি বড় কারণ ছিল দেদারছে হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়া। একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া ও অন্যদিকে হিমালয়ের বরফ গলার মতো ঘটনা এশিয়ার একাংশকে দীর্ঘমেয়াদে ভোগাবে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব।