রিপন হোসেন সাজু, মনিরামপুর (যশোর) :
যশোর-৫ (মনিরামপুর) সংসদীয় আসন। যশোরের ছয়টি আসনের মধ্যে এই আসনটি সর্ববৃহৎ এবং উক্ত আসনটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। আসনটিতে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। দীর্ঘদিন একক রাজত্ব করলেও আসনটিতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন কোন্দল রয়েছে অনেক। তবে কোন্দল মিটিয়ে ফেলতে পারলে আগামী নির্বাচনেও আওয়ামীলীগ ভালো ফল করতে পারে।
অন্যদিকে নৌকার ঘাঁটিতে ফাটল ধরিয়ে বিএনপি চাইছে আসনটি নিজেদের কব্জায় আনতে। তবে দু’দলেই একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর ভিড়ে জমে উঠেছে আসনটিতে। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামীলীগের স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য। এর আগেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে নির্বাচনী এলাকায় চমক দিয়েছিলেন। আগামী নির্বাচনেও তিনি শক্ত প্রতিদ্বদ্বী।
অন্যদিকে, বিএনপি-জামায়াতের বড় বড় নেতাদের নামে একাধিক মামলা থাকায় তাদের অধিকাংশ এখনো নির্বাচনী মাঠে জোরেশোরে নামতে পারছেন না। কিন্তু বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মনে করছেন, সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপির জেতার সম্ভাবনা অনেক বেশি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির অনেক মনোনয়ন প্রত্যাশী এলাকায় ঘুরছেন এবং গণসংযোগ করছেন।
তারা হলেন- বর্তমান এমপি স্বপন ভট্টাচার্য্য, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল মজিদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য এসএম ইয়াকুব আলী, আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল হাসান বারী, অ্যাডভোকেট খান টিপু সুলতানের স্ত্রী ডাক্তার জেসমিন আরা, জেলা যুবলীগের সভাপতি ও যশোর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা ফারুক আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ।
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন- মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালিক সাধারণ সম্পাদক জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোহাম্মদ মুছা, মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও পৌরসভার সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট শহীদ মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখার সেলিম অগ্নি। তারা তিনজনই মাঠে রয়েছেন।
এ ছাড়াও জামায়াত ইসলামের নেতা এডঃ গাজী এনামুল হক, জাগপার কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও যশোর জেলা প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নিজাম উদ্দিন অমিত, জাতীয় পার্টির যশোর জেলার সভাপতি শরিফুল ইসলাম সরু চৌধুরী ও মনিরামপুর উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এমএ হালিমের নাম শোনা যাচ্ছে। মনিরামপুর উপজেলায় ১৭ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে যশোর-৫ নির্বাচনী এলাকা। এখানে ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ১৩ হাজার ৯শ’ ৯৩ জন।
এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৫৭ হাজার ৩শ’ ৪৪ জন ও মহিলা ভোটার এক লাখ ৫৬ হাজার ৬শ’ ৪৯ জন। নতুন ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৪শ’ ৯৭ জন। নির্বাচন অফিস সূত্রে আরও জানা গেছে, হালনাগাদ তালিকায় এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ১৯৮৬ সালে এখানে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে জয়ী হন মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস। ১৯৮৮ সালে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ফের এমপি হন।
১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট খান টিপু সুলতান, ১৯৯৬ সালে বিএনপির আফসার আহমেদ সিদ্দিকী, ওই বছরের জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট খান টিপু সুলতান, ২০০১ সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের প্রার্থী মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট খান টিপু সুলতান, ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হন কলস প্রতীক নিয়ে স্বপন ভট্টাচার্য্য। সর্বশেষ ২০১৮ সালেও আওয়ামী লীগ থেকে স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি নির্বাচিত হন। যশোরের এই আসনে সংখ্যালঘু ভোটার সবচেয়ে বেশি। আওয়ামী লীগের ভোটের একটি প্লাস পয়েন্ট তারা। স্বপন ভট্টাচার্য্য পর পর দুইবার এমপি হয়েছেন।
বর্তমানে তিনি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী। এলাকায় তিনি নিয়মিত আসেন এবং দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেন। তবে আসনটিতে আওয়ামী লীগে কোন্দল রয়েছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, মনিরামপুর পৌরসভার মেয়র অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেন লাভলু, সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য্যরে সঙ্গে আছেন।
অন্যদিকে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক ফারুক হোসেন, মনিরামপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নাজমা খানম, মনিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, সাবেক পৌরমেয়র ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু, মনিরামপুর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সভাপতি মিকাইল হোসেন এমপির বিপক্ষ গ্রæপ বলে পরিচিত। এ নিয়ে রাজনীতিতে সেখানে ব্যাপক কোন্দল।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি মোস্তফা কামাল, যার বাড়ি মনিরামপুর হরিহরনগর ইউনিয়নে। তিনি বলেন, নব্য আওয়ামীলীগের কারণে মনিরামপুরে অনেক ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। তারা এখনো আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়ান। মনিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরমেয়র অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান বলেন, মনিরামপুরে আওয়ামী লীগ অনেক শক্তিশালী। এখানে আওয়ামী লীগে কোনো কোন্দল নেই।
বড় দল তাই অনেকে মনোনয়ন চাইতে পারে। বর্তমান এমপি স্বপন ভট্টচার্য্য অনেক কাজ করেছেন। মনিরামপুরের মানুষ আবারও তাকে এমপি হিসেবে দেখতে চায়। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী আব্দুল মজিদ বলেন, ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করছি। আমি ১৯৮১ সালে ঢাকার ধানমন্ডি থানার ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। এর আগে ১৯৮০ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলাম। সেই থেকে আমি দলের দুর্দিনে ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগের নানা পদে থেকে দলের জন্য কাজ করেছি। আমি মনোনয়ন প্রত্যাশী। দলের নেত্রী আমার অতীত রাজনীতি জানেন।
আমি মনোনয়ন পেলে মনিরামপুর বাসীর জন্য কাজ করব। মনিরামপুরে বিএনপির জনপ্রিয় নেতা, উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালিক সাধারণ সম্পাদক জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোহাম্মদ মুছা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি করছি। তৃণমূল বিএনপির সঙ্গে আমার যোগাযোগ নিবিড়। তারা বিপদে-আপদে আমার কাছে আসে। আমি তাদের পাশে দাঁড়াই। আমার পরিবার এবং আমার নেতা কর্মীদের নামে অনেক মামলা রয়েছে। শত শত মামলা দিয়েও আমাদের বিএনপি থেকে এক চুল সরাতে পারেনি বর্তমান সরকার। সুষ্ঠ নির্বাচন হলে এখানে মানুষ বিএনপিকে ভোট দেবে। আমি দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। দল মনোনয়ন দিলে আমি নির্বাচন করব। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে বিএনপি সে নির্বাচনে যাবে না।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী এস এম ইয়াকুব আলী বলেন, আমি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলাম। আমার পরিবারের সকলে আওয়ামী লীগ করে। আমিও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য। মনিরামপুরের মানুষের সঙ্গে আছি। তাদের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াই। জলাবদ্ধ এলাকায় আমি দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ দিয়েছি। অনেক দরিদ্র পরিবারের ঘর করে দিয়েছি। এ সব কাজে মনিরামপুরের আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে রয়েছেন। আমি মনোনয়ন চাইব। একই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী কামরুল হাসান বারী বলেন, আমি ২০০১ সালের পর থেকেই এলাকাবাসীর খেদমত করছি।
২০০৮ সাল থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আছি। স্থানীয় হাট-বাজারে গিয়ে চায়ের দোকানে বসে তাদের সুখ-দুঃখের গল্প শুনি। যতদূর পারি, মানুষকে সাহায্য করি। মনিরামপুরের মানুষ আমাকে ভালোবাসেন, আমি মনোনয়ন চাইব। মনিরামপুর পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। আমি পশ্চিম অঞ্চলের বাসিন্দা। আমার এলাকায় ভোটার বেশি। আমি মনোনয়ন পেলে এলাকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আমাকে ভোট দেবে।
জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখার সেলিম অগ্নি অনেক দিন ধরে এলাকায় গণসংযোগ করছেন। ব্যবসায়ী এই নেতা ঢাকায় থাকলেও এলাকায় সবসময় আসেন এবং দলীয় কর্মসূচিগুলোতে অংশ নেন। ছাত্রদলের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে আসেন। বর্তমানে তিনি স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজশাহী বিভাগীয় টিমের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, নির্বাচন পরে, আগে আমাদের নেতা তারেক রহমানের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার চাই।
তাকে দেশে আসতে দিতে হবে। তারপর নির্বাচন হবে। এর আগে কোনো নির্বাচন নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে মনিরামপুরে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। তৎকালিন এই উপজেলার ৫৬টি ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেয় বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা। সেই ঘটনায় শতাধিক মামলা হয়। ফলে কোনঠাসা হয়ে পড়ে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা। সেই থেকে তারা এখন প্রকাশ্যে আর বড় কোনো কর্মসূচি করতে পারেনি। গ্রাম এলাকার অনেক বিএনপি-জামায়াতের কর্মী এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে রয়েছে। অনেকেই আবার আওয়ামীলীগের ছত্র ছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ।