জাতীয় ডেস্ক:
গৃহবধূ মিম আক্তার সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে একটি সরকারি সেলাই মেশিনের আশায় জনপ্রতিনিধির কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি জমা দিয়েছিলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের প্রতিশ্রুতিতে সেলাইমেশিন পাওয়ার আশায় কৃষক স্বামীর পাশাপাশি সংসার অবদান রাখতে পারার আনন্দে উচ্ছ্বসিত হন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে জোটেনি সেলাই মেশিন। উপজেলা এলজিইডি কার্যালয় থেকে মুঠোফোনে ডেকে সামনে সেলাই মেশিন রেখে ছবি তুলে স্বাক্ষর করে মিমকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর প্রায় ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও দেয়া হয়নি সেলাইমেশিন।
শুধু মিম আক্তার নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার অন্তত ১১ নারীকে সেলাই মেশিন দেওয়ার নামে উপজেলায় ডেকে মেশিনগুলো সামনে রেখে স্বাক্ষর নিয়ে ছবি তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। সম্প্রতি এ ঘটনায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডি রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক ও চাঁপাইনবাগঞ্জ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মোসা. শাহনাজ খাতুন।
ভুক্তভোগী নারীদের অভিযোগ, সরকারি প্রকল্পের টাকায় সেলাই মেশিন দেওয়ার কথা বলে তাদের ডাকা হয় উপজেলা পরিষদে। তাদের সামনে সেলাই মেশিনগুলো রেখে ছবিও তোলেন উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের লোকজন। তবে পরে ওই মেশিনগুলো তাদের না দিয়ে ফেরত নিয়ে নেয় তারা। ছবি তোলার পাশাপাশি স্বাক্ষরও নেয়া হয় ওই নারীদের।
জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নারী উন্নয়ন ফোরামের জন্য মোট প্রাপ্ত বরাদ্দের ৩ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। যার পরিমাণ ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে ২৭টি হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যথাযথ নিয়ম অনুসারে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতা ঠিকাদার নির্বাচিত হন।
ভোলাহাট উপজেলার বজরাটেক পিরানচক এলাকার বাসিন্দা ভুক্তভোগী মিম আক্তার বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। গরু-ছাগল পালন করি। কিন্তু দৈনিক আয়ের কোনো উৎস নেই। তাই সেলাই মেশিন চালানো শিখেছিলাম। পরে জানতে পারি উপজেলা থেকে সরকারি সেলাই মেশিন দেওয়া হবে। এজন্য জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি জমা দিয়েছিলাম। কিছুদিন পর উপজেলা হিসাব সহকারী মো. মকলেছুর রহমান আমাকে ফোন দিয়ে ডাকেন। ফোন পেয়ে উপজেলায় যাই। এসময় আমার সামনে সেলাই মেশিন রেখে ছবি ও স্বাক্ষর নিয়ে বলে পরে আপনাদের সেলাই মেশিন দেওয়া হবে আজকে চলে যান। কিন্তু অনেক দিন হয়ে গেলো, আমরা আর মেশিন পাইনি।’
উপজেলার আলীসাহাসপুর বজরাটের এলাকার বাসিন্দা মো. শাজাহান আলীর মেয়ে চারমিস খাতুন বলেন, ‘অনেকদিন থেকেই সেলাই মেশিনের কাজ জানি। কিন্তু টাকার অভাবে সেলাই মেশিন কিনতে পারছিলাম না। এসময় জানতে পারি উপজেলা এলজিইডি থেকে সরকারিভাবে সেলাই মেশিন বিতরণ করা হবে। এজন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছিলাম। পরে গত দুই মাস আগে উপজেলায় ডেকে সেলাই মেশিন সামনে নিয়ে আমাদের ছবি তুলে কাগজে সই করিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু সেলাই মেশিন দেননি। বলেছেন পরে ডেকে দেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। আজও অপেক্ষায় আছি।’
সুরমা খাতুন নামের আরেক নারী বলেন, ‘আইডি কার্ড নিয়ে সই নিলো, সেলাই মেশিনের সামনে ছবি তুললো। ছবি তুলে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেলাই মেশিন দেইনি। পরে দেবো বলে এখনও কোনো খবর নেই।’
এ প্রকল্পের আওতায় সেলাই মেশিন পেয়েছেন উপজেলার বাহাদুরগঞ্জ গ্রামের মাসুদ রানার স্ত্রী মৌসুমী খাতুন। তিনি বলেন, ‘উপজেলা এলজিডি থেকে মুঠোফোনে আমাদেরকে ডেকে সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে। আমার সঙ্গে আরও ১০-১৫ জন ছিল। তবে এই মেশিনটি একেবারেই নিম্নমানের। কাজ করা যায় না। এমন অচল জিনিস না দিলেও পারতো।’
উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের হিসাব সহকারী মুকলেছুর রহমান বলেন, ‘যাদেরকে মুঠোফোনে ডাকা হয়েছে তাদের সবাইকে সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে। একেকটি সেলাই মেশিনের বাজেট ছিল প্রায় ৮ হাজার টাকা।’
এবিষয়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি এলজিইডির ভোলাহাট উপজেলা প্রকৌশলী মো. আছহাবুর রহমান। তার দাবি, তার সময়ে হয়নি প্রকল্পটি। তবে ঈদুল ফিতরের আগে সেলাই মেশিনগুলো বিতরণ করা হয়েছে। কোনো মেশিন ফেরত নেয়া হয়নি।
অভিযোগের তীর উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহনাজ খাতুনের দিকে তুলে এই উপজেলা প্রকৌশলী বলেন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান এসব বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। যারা সেলাই মেশিন পেয়েছেন তাদের শিখিয়ে দিয়ে এসব কথা বলতে বাধ্য করছেন। আর কিছুই না।
এবিষয়ে উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহনাজ খাতুন বলেন, মহিলাদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ প্রকল্পের জন্য ২৭ জনের নাম তালিকাভুক্ত করে এলজিইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে তারা ১৬ জনের মাঝে মেশিনগুলো বিতরণ করেন। কিন্তু বাকি ১১ জনকে কয়েক দফায় ডেকে সই নিয়ে সেলাই মেশিন সামনে রেখে ছবি তুলে তা ফেরত নেওয়া হয়। এনিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো সুরাহা হয়নি।
ঠিকাদার আব্দুল গণি বলেন, ‘আমার ব্যবসায়ীক এক সহযোগীর মাধ্যমে উপজেলা এলজিইডির কাছে সেলাই মেশিন দিয়েছিলাম। আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা। এসব কাজের সঙ্গে কখনোই জড়িত ছিলাম না।’
চাঁপাইনবাগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোজাহার আলী প্রাং বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সেলাইমেশিন বিতরণে কোনো অনিয়ম হয়নি বলেও দাবি এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর।