আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
আর অল্প সময়ের অপেক্ষা। ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে কে যুক্তরাষ্ট্রের হাল ধরছেন তা জানা যাবে শিগগিরই। আর তার আগেই সমাপ্ত করতে হবে এক জটিল প্রক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) রাতে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর শুরু হবে গণনা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণ ও ভোট গণনা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
এবার ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকানদের হয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অপেক্ষা এখন ভোট গণনা ও ফল ঘোষণার। সেই ক্ষেত্রেও পদ্ধতিটা খুবই জটিল। এ ক্ষেত্রে কোন প্রার্থী কত ভোট পেলেন তার চেয়ে জরুরি হলো- কে কতটা ইলেক্টোরাল ভোট পেলেন।
দুই অঙ্গরাজ্য ব্যতীত অন্যগুলোতে যে দল বেশি ভোট পায়, সেটির ইলেক্টোরাল ভোট সে দলের ভাগে যায়। তবে মেইন ও নেবরাস্কায় মোট ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে ইলেকটোরাল ভোট ভাগ করা হয়।
ইলেক্টোরাল কলেজ কী?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ইলেক্টোরাল কলেজ আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে ভূমিকা পালন করে। ৫৩৮ জন ইলেক্টরের সমন্বয়ে ইলেক্টোরাল কলেজ গঠিত। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে প্রার্থীকে এর মধ্যে অন্তত
২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হয়। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের কংগ্রেশনাল প্রতিনিধিদের সংখ্যার ভিত্তিতে ইলেক্টর নিযুক্ত করা হয়। ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় কোনও কংগ্রেস প্রতিনিধি না থাকায় সেখানে তিন জন ইলেক্টর এমনি নিযুক্ত করা হয়। অর্থাৎ সর্বমোট ৪৩৫ জন হাউজ রিপ্রেজেন্টিটিভ, ১০০ জন সিনেটর ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার তিন ইলেক্টরসহ ৫৩৮ জন ইলেক্টর হিসেব করা হয়।
ইলেক্টর ভাগ হয় যেভাবে
অঙ্গরাজ্যগুলোতে ইলেক্টরের সংখ্যায় ভিন্নতা রয়েছে। নির্বাচনের দিন মার্কিনিরা যখন ভোট দেন তখন তারা মূলত প্রার্থীদের বাছাই করা ইলেক্টরদেরকে ভোট দেন। দুটি ছাড়া বাকি ৪৮টি অঙ্গরাজ্যে ‘উইনার-টেক-অল’ সিস্টেম চালু রয়েছে। এর আওতায় জয়ী প্রার্থীকে ওই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেক্টর দিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইলেক্টর রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। এখানকার ইলেক্টরের সংখ্যা ৫৫। এরা সাধারণত দলের কর্মী, সদস্য বা দলের প্রতি অনুগত লোকজন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অংশ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ যখন ভোট দেন, তখন তারা মূলত তারা প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে নয় বরং তার নিযুক্ত ইলেক্টরদের ভোট দেন। এখন ক্যালিফোর্নিয়াতে যিনি জিতবেন তিনি ৫৫ জন ইলেক্টরই জয় করে নেবেন। আর পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও ইলেক্টর পাবেন না।
এভাবে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ৫৩৮ পয়েন্টের ভেতর কেউ যদি অর্ধেকের চেয়ে এক বেশি অর্থাৎ অন্তত ২৭০ পয়েন্ট পায়, তাহলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন।
৫০টি অঙ্গরাজ্য, ওয়াশিংটন ডিসি ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ইলেক্টরাল ভোটের সংখ্যা ওয়াশিংটন ডিসিতে ১২, মন্টানায় ৩, নর্থ ডাকোটায় ৩, মিনেসোটায় ১০, উইসকনসিনে ১০, মিশিগানে ১৬, নিউ ইয়র্ক ২৯, ভারমন্টে ৩, নিউ হ্যাম্পশায়ারে ৪, মেইনে ৪,
ম্যাসাচুসেটসে ১১, রোড আইল্যান্ডে ৪, কানেকটিকাটে ৭, নিউ জার্সিতে ১৪, ডেলাওয়ারে ৩, ম্যারিল্যান্ডে ১০ ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়াতে ৩টি ইলেক্টরাল ভোট রয়েছে।
এছাড়া ওরিগনে ৭, ইডাহোতে ৪, ওয়াইওমিংয়ে ৩, সাউথ ডাকোটায় ৩, নেবরাস্কায় ৫, আইওয়াতে ৬, ইলিনয়ে ২০, ইন্ডিয়ানায় ১১, ওহাইওতে ১৮, পেনসিলভানিয়ায় ২০,
নেভাদায় ৬, ইউটায় ৬, কলোরাডোতে ৯, কানসাসে ৬, মিসৌরিতে ১০, কেন্টাকিতে ৮, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ৫, ভার্জিনিয়াতে ১৩, ক্যালিফোর্নিয়ায় ৫৫, আরিজোনায় ১১, নিউ মেক্সিকোতে ৫, টেক্সাসে ৩৮, ওকলাহোমায় ৭, আরকানসাসে ৬, টেনেসিতে ১১, নর্থ ক্যারোলিনায় ১৫, লুইজিয়ানায় ৮, মিসিসিপিতে ৬, আলাবামায় ৯, জর্জিয়ায় ১৬, সাউথ ক্যারোলিনায় ৯, ফ্লোরিডায় ২৯, হাওয়াইতে ৪ এবং আলাস্কায় ৩টি ইলেক্টরাল ভোট রয়েছে।
একেক অঙ্গরাজ্যে ইলেক্টরের সংখ্যা একেকরকম কেন?
সাধারণত জনসংখ্যার ওপর ইলেক্টরের সংখ্যা নির্ভর করে। অবশ্য নিয়ম হলো, প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে জনসংখ্যা যেমনই হোক, ন্যূনতম তিন পয়েন্ট দিতেই হবে। এরপর জনসংখ্যা অনুসারে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় প্রতি ১০ বছর পরপর। যেমন ২০০৪ সালে
ফ্লোরিডার ছিল ২৭ ইলেক্টোরাল কলেজ। এখন ২৯ হয়েছে। অর্থাৎ ফ্লোরিডাতে জনসংখ্যা বেড়েছে। ছোট অঙ্গরাজ্যগুলো যাতে নির্বাচনে গুরুত্ব না হারায় সে বিষয়টিকে এক্ষেত্রে মাথায় রাখা হয়। যেমন মন্টানা অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা ১০ লাখ। আবার
ওয়াইওমিং অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা ৫ লাখ ৮৪ হাজার। অথচ দুই রাজ্যেই ইলেক্টোরাল ভোট সমান তিনটি করে।
অর্থাৎ ১০ লাখ জনসংখ্যার মন্টানাতে জিতে যে সংখ্যক ইলেক্টোরাল ভোট পাওয়া যাবে তার চেয়ে অর্ধেক জনসংখ্যার রাজ্য ওয়াইমিং-এ জিতেও ৩ পয়েন্ট পাওয়া যাবে।
নির্বাচনের ফল কখন জানা যাবে
কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে কয়েক সপ্তাহ ধরেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে জাতীয় ও দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যে দুই প্রার্থীর এখন পর্যন্ত ভোটের ব্যবধান খুব সামান্যই। ফলে অনেক স্থানে অল্প ভোটের ব্যবধানেই জয় নির্ধারিত হতে পারে। তখন আবার ভোট পুনর্গণনার প্রয়োজন দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০২০ নির্বাচনের পর থেকে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য তাদের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় কী পরিবর্তন এনেছে, তার ভিত্তিতে কিছু রাজ্যের ভোট গণনায় কিছুটা বিলম্ব হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
অন্যদিকে, মিশিগানের মতো কিছু রাজ্যে দ্রুতগতিতে চলছে ভোটগণনা। এ ছাড়া, এবার ডাকযোগে ভোট দেওয়ার সংখ্যাও কমতে পারে।
ফলে, ৪৭ তম প্রেসিডেন্টের নাম যেমন নির্বাচনের রাতেও (অর্থাৎ মঙ্গলবার রাতে) জানা যেতে পারে। আবার ঘোষণা আসতে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ সময়ও প্রয়োজন হতে পারে।
আগেরবার যা ঘটেছিল
২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচন হয়েছিল ৩ নভেম্বর, মঙ্গলবার। তবে মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যমগুলোতে ৭ নভেম্বর জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে খবর প্রচার করা হয়। নির্বাচনের রাতেই জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উৎফুল্ল হয়ে পড়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সমর্থকরা। তবে দুই প্রার্থী জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ২৭০ ইলেক্টোরাল কলেজ পাওয়ার খুব কাছেই ছিলেন।
নির্বাচনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অধিকাংশ রাজ্য তাদের ভোট গণনার পর ফল ঘোষণা করেছিল। তবে পেনসিলভিনিয়া ও নেভাডাসহ কিছু রাজ্য কিছুটা বিলম্ব করে। পেনসিলভিনিয়াতে ডেমোক্র্যাটদের জয়ের আভাস দেখা দিয়েছিল। ৭ নভেম্বর সকালে নতুন এক ব্যাচ ব্যালট গণনার পর চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঙ্গরাজ্যটিতে বাইডেন
জিততে যাচ্ছেন বলে প্রচার শুরু করে টিভি চ্যানেলগুলো। সবার আগে ফল ঘোষণা করেছিল সিএনএন। বাকি টিভি চ্যানেলগুলো ১৫ মিনিট পর থেকে এই খবর প্রচার শুরু করে।
সাধারণত যখন ফল জানা যায়
সাধারণত, ভোটের রাতে বা পরদিন সকালেই মার্কিনিরা তাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের নাম জেনে যান। যেমন, ২০১৬ সালে নির্বাচনের পরদিন ট্রাম্পকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ২০১২ সালে ভোটের দিন মাঝরাতেই বারাক ওবামাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে, জর্জ ডব্লিউ বুশ ও আল গোরের ২০০০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণায় যথেষ্ট বিলম্ব হয়। ওই বছর ১২ ডিসেম্বর আদালতের হস্তক্ষেপে ফ্লোরিডার
লড়াইয়ের অবসান ঘটে।
এতে ফল পেতে বিলম্ব হতে পারে। ভোটের ব্যবধান সামান্য হলে গণমাধ্যমে বিজয়ী ঘোষণা করতে বিলম্ব করে থাকে। তবে এসব ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া ও ভোট
পুনর্গণনার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
যেমন পেনসিলভিনিয়ার আইন অনুযায়ী, দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ হলে, রাজ্যব্যাপী ভোট পুনর্গণনা শুরু হয়। ২০২০ সালে এই ব্যবধান ছিল এক দশমিক এক শতাংশের কিছু বেশি।
ইতোমধ্যেই ভোটারের যোগ্যতা ও নির্বাচনি কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জ করে দেশব্যাপী শতাধিক প্রাক-নির্বাচনি মামলা করেছে রিপাবলিকানরা। এ ছাড়া ভোট গ্রহণ স্থানে কোনও বিশৃঙ্খলার কারণেও ফল পেতে বিলম্ব হতে পারে। যেমন, ২০২০ সালে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনার স্থানে একটি পানির পাইপ ফেটে যাওয়ায় কাজ শেষ করতে বিলম্ব হয়েছিল।
ভোটের ফল চ্যালেঞ্জ করলে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়
সমস্ত বৈধ ভোট চূড়ান্ত ফলে অন্তর্ভুক্তি ও পুনর্গণনার মতো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে, নির্বাচনি ফল প্রথমে রাজ্যস্তরে ও পরে জাতীয়ভাবে সার্টিফাই করা হয়। এরপর গভর্নর তখন একটি নির্বাচক প্যানেলকে দায়িত্ব দেবেন। তারা ইলেক্টোরাল কলেজে নিজ রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করবেন । ওই নির্বাচকরা ১৭ ডিসেম্বর নিজ নিজ রাজ্যে মিলিত হয়ে তাদের ভোট প্রদান করে সেগুলো ওয়াশিংটনে পাঠাবেন। এরপর ৬ জানুয়ারি, দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্টের সভাপতিত্বে মার্কিন কংগ্রেস ভোট গণনার জন্য বৈঠক করবে।
যেসব নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় এবং যখন কোনও প্রার্থী পপুলার ভোটে না জিতেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয় পান, তখনই ইলেক্টোরাল কলেজ সিস্টেমে পরিবর্তন আনার জন্য আহ্বান জানানো হয়। একটি আনুপাতিক ব্যবস্থা চালুর জন্য কয়েকটি অঙ্গরাজ্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব করলেও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি।
সূত্র: দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, বিবিসি, আল জাজিরা, উইকিপিডিয়া