নিজস্ব প্রতিনিধি :
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এর নেতৃবৃন্দের কাছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া জানিয়ে সাতক্ষীরায় ‘জলবায়ু পদযাত্রা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। পদযাত্রা ও সামবেশে বক্তারা বলেছেন, উন্নত বিশ্ব প্রতিনিয়ত কার্বন নি:সরণ করছে। ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিলাসী জীবনযাপনের খেসারত বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলোকে দিতে হচ্ছে।
জলবায়ু অভিঘাতের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমা লের জেলা সাতক্ষীরার দুটি উপজেলা আশাশুনি ও শ্যামনগরের মানুষ প্রতিনিয়ত জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এসব জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেয়ে বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে মানুষের রোগব্যাধি বাড়ছে। ফসলের জমি বিরান হয়ে যাচ্ছে।
ধনী দেশগুলোর অতিক্তি কার্বণ নি:সরণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মানুষকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করতে হবে। সোমবার ৮ নভেম্বর, ২০২১ সকাল ১০টায় সাতক্ষীরা নিউ মার্কেট মোড় (শহীদ আলাউদ্দীন চত্বর) থেকে জলবায়ু পদযাত্রা শেষে শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে মুক্তমে অনুষ্ঠিত সমাবেশে নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন।
স্বদেশ, উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন) Coastal Livelihood and Environmental Action Network (CLEAN) ও এশিয়ান পিপলস্ মুভমেন্ট অন ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এপিএমডিডি) Asian People’s Movement on Debt and Development (APMDD) যৌথভাবে এ কর্মসূচির আয়োজন করে। শহরে জলবায়ু পদযাত্রা শেষে সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পরিবেশিত হয়।
জলবায়ু পদযাত্রা শেষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, শিক্ষাবিদ ও নাগরিক ব্যক্তিত্ব আবদুল হামিদ, জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক আনিসুর রহিম, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ জাসদ, জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদদক অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, ভূমিহীন নেতা ও জেলা নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব আলী নুর খান বাবুল, উদীচীর জেলা কমিটির সভাপতি শেখ সিদ্দিকুর রহমান, ক্রিস্টেন্টের নির্বাহী পরিচালক আবু জাফর সিদ্দিকী, উন্নয়নকর্মী ফারুক রহমান, ক্লাইমেট এক্টিভিস্ট এস এম শাহিন বিল্লাহ, ব্যবসায়ি মিজানুর রহমান, সাংস্কৃতিককর্মী একোব্বার হোসেন, শিক্ষার্থী শিখা প্রমুখ। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা ও সমন্বয় করেন মানবাধিকারকর্মী ও স্বদেশ’র নির্বাহী পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত।
বক্তারা বলেন, গত ৩১ অক্টোবর শুরু হয়ে আগামী ১২ নভেম্বর পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের রাজধানী গ্লাসগোতে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ সম্মেলনে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চারটি মূল দাবি তুলে ধরেছেন। দাবিগুলো হলো : (১) কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করা (২) উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়া (৩) জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে নবায়নযোগ্য ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করা এবং (৪) জলবায়ু উদ্বাস্তু এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতি ও ধ্বংসের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে সারা পৃথিবী জুড়ে দুর্যোগের সংখ্যা ও ভয়াবহতা দুটোই বেড়ে গেছে। আর এতে ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। গত ২০ বছরে যেসব দেশ জলবায়ু দুর্যোগ আক্রান্ত প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে দেশের উপকূলীয় ও উত্তরাঞ্চলে লবণাক্ততা, খরা, বন্যা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে জীবিকা হারিয়ে প্রতি বছর পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ জলবায়ু-উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ বাতাসে অতিরিক্ত কার্বন নির্গমন ও তার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে প্যারিসে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্যারিস চুক্তির উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এ লক্ষ্য পূরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল ও ভারতের মতো বড় নির্গমনকারী দেশ কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ফলে মানবজাতি রক্ষার উদ্যোগ অনেকটাই ব্যর্থ হবে। মানবজাতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য এসব দেশের লজ্জা পাওয়া উচিৎ।
স্বদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, বাতাসে কার্বন নির্গমনের ৭২ শতাংশই আসে জ্বালানি খাত থেকে। কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি তেলখাতে উন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ৪০টি দেশ জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জার্মানি, জাপান, চীন, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়ামের মতো বড় বিনিয়োগকারী দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধ করার কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এসব দেশের অবিলম্বে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে।
বক্তারা অবিলম্বে কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধ করা, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জলবায়ু-বিপদাপন্নদের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে সহায়তা করা, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দাবি জানান।
