নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রথমবারের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আর্থিক খাতের পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়ে, স্বায়ত্তশাসিত এবং জবাবদিহিমূলক রূপ দিতে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ২০২৫’ নামে একটি অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক উচ্চপদস্থ সূত্র জানিয়েছে, আইনটির খসড়া ইতোমধ্যে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক পর্যালোচনা করেছে এবং চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হতে পারে। আইনটি কার্যকর হলে বাংলাদেশ ব্যাংক হবে একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান, যার জবাবদিহি কেবল সংসদের কাছে থাকবে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের দীর্ঘদিনের বিতর্কিত অধ্যায় বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
নতুন আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান হবে সংবিধানে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাতারে। অর্থাৎ, এটি হবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর একটি সাংবিধানিক স্তম্ভ। গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের ছয় বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হবে সংসদের অনুমোদন ও প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের মাধ্যমে। অপসারণের ক্ষেত্রেও থাকবে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও আনুষ্ঠানিক শুনানির বিধান।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের আগে শপথ নেবেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সামনে, যা সংবিধানিক মর্যাদার একটি বড় প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ।
স্বশাসন, স্বাধীনতা ও একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের নতুন কাঠামো
নতুন আইনের অন্যতম বৈপ্লবিক দিক হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বায়ত্তশাসন। এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে— বাংলাদেশ ব্যাংক হবে ব্যাংক খাতের একক নিয়ন্ত্রক ও তদারকি কর্তৃপক্ষ; বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত—সব ধরনের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় থাকবে ব্যাংকের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব এবং মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, তারল্য ব্যবস্থাপনা, এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংককে ‘নির্বাহী বিভাগের একটি সংযুক্ত দফতর’ থেকে সরিয়ে এনে একটি সত্যিকারের আর্থিক সংবিধান রক্ষাকারী সংস্থায় পরিণত করবে।
কেন এত বড় পদক্ষেপ?
দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিয়ে দ্বৈত শাসনের অভিযোগ ছিল—একদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব, অন্যদিকে আইনগত সীমাবদ্ধতা। ফলে দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছ নিয়োগ, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং অপর্যাপ্ত তদারকিতে সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাংক খাতের ‘সিস্টেমিক রিস্ক’। ২০২১-২৫ মেয়াদে রিজার্ভ পতন, দুর্বল ব্যাংকের সংকট, উচ্চ খেলাপি ঋণ, এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দুর্নীতির ঘটনা একের পর এক এ বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে আসে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রূপান্তর কেবল আইএমএফ-এর চাপে নয়, বরং দেশের অর্থনীতিকে টেকসই করতে অভ্যন্তরীণভাবেই দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত একটি দাবির প্রতিফলন।
কী থাকছে নতুন আইনে?
নতুন আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাঠামো ও কর্তৃত্ব হবে অনেক বেশি শক্তিশালী, স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এতে অন্তত ৭টি মূল পরিবর্তন আসছে যা পুরো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চরিত্র ও ক্ষমতার রূপান্তর ঘটাবে।
সাংবিধানিক মর্যাদা ও সংসদীয় নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশ ব্যাংককে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, যার জবাবদিহি থাকবে কেবল জাতীয় সংসদের কাছে। গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের ছয় বছরের মেয়াদে নিয়োগ, অপসারণ, কিংবা পুনর্নিয়োগ—সবকিছুতেই সংসদের অনুমোদন এবং প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ বাধ্যতামূলক থাকবে।
গভর্নরকে শপথ নিতে হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সামনে, যা অন্য কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নেই।
গভর্নরের মর্যাদা বাড়ছে, হবেন মন্ত্রীর সমমর্যাদার
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের মর্যাদা ১৪তম গ্রেডে (সচিবের নিচে)। নতুন আইনে তাকে মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে এবং তিনি হবেন রাষ্ট্রীয় প্রোটোকলে চতুর্থ অবস্থানে। এর ফলে সরকারের উচ্চপর্যায়ে তার কণ্ঠস্বর অনেক বেশি কার্যকর হবে।
গভর্নর হবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। তবে একক কর্তৃত্বের বদলে রাখা হয়েছে ‘নির্বাহী উপদেষ্টা কমিটির’ পরামর্শের বাধ্যবাধকতা—যা মুদ্রানীতি ও নিরীক্ষা ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে গভর্নরের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে।
অর্থনীতি, রাজস্ব ও মুদ্রানীতির সামগ্রিক সমন্বয়ে গঠিত হবে একটি ‘সমন্বয় পরিষদ’, যার নেতৃত্বে থাকবেন অর্থমন্ত্রী। এ পরিষদের সদস্য হবেন পরিকল্পনামন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থসচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা
বাংলাদেশ ব্যাংক হবে দেশের একক নিয়ন্ত্রক (সোল রেগুলেটর) সংস্থা। এর আওতায় থাকবে— সব বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক; ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন; মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; ব্যাংক রেজল্যুশন ও পুনর্গঠন এবং ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি।
আইএমএফ ও বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কোনও মন্ত্রণালয় বা বাহ্যিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজস্ব নীতিমালায় এসব সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পেশাদার পরিচালনা পর্ষদ, সরকারি কর্মকর্তা নিষিদ্ধ
প্রতিষ্ঠানে থাকবে একটি ৮ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ, যাদের মধ্যে থাকবে: গভর্নর (সভাপতি); দুজন ডেপুটি গভর্নর এবং পাঁচ জন বেসরকারি স্বাধীন সদস্য। এই পাঁচ সদস্যের প্রত্যেকের অর্থনীতি, ব্যাংকিং, হিসাবরক্ষণ, আইন বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কোনও সরকারি কর্মকর্তা বা আমলাকে এতে রাখা যাবে না।
এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ পেশাদার ও আমলাবিহীন বোর্ড গঠনের পদক্ষেপ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘দ্বৈত শাসনের কারণে এতদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতো না। নতুন আইনে বোর্ড হবে স্বাধীন, পেশাদার ও কার্যকর।’
দুর্বল ব্যাংকের জন্য রেজল্যুশন ইউনিট
ব্যাংক খাতের দীর্ঘদিনের দুর্বলতা মোকাবিলায় প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক গঠন করবে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন বিভাগ’। এই বিভাগ হবে ব্যাংক বন্ধ, পুনর্গঠন, পর্ষদ বাতিল, সম্পদ হস্তান্তরসহ সব রেজল্যুশন কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রক।
আইএমএফের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, এবং সরকার প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েও স্থায়ী সমাধান দিতে পারছে না। এই অবস্থার অবসানে নতুন আইনের প্রস্তাবিত রেজল্যুশন ক্ষমতাকে বিশ্লেষকরা বলছেন ‘গেমচেঞ্জার’। অর্থাৎ আইনের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক পাবে ব্যাংক রেজল্যুশন পরিচালনার স্বাধীন ও শক্তিশালী ক্ষমতা।
দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকগুলো চিহ্নিত করে— পর্ষদ বাতিল; নতুন পর্ষদ নিয়োগ; ব্যাংক একীভূতকরণ; মূলধন সংস্কার এবং সম্পদ হস্তান্তর। এমনকি প্রয়োজনে ব্যাংক বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ১৫টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ১৪টির পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হয়েছে, একটি ব্যাংকে বসানো হয়েছে প্রশাসক। পাশাপাশি, ব্যাংক মালিকদের পরিচয় প্রকাশ ও ‘বেনামি মালিকানা’ রোধে নতুন নীতিমালা কার্যকর হয়েছে।
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘একীভূতকরণ ছাড়া এসব ব্যাংক টিকবে না। পাঁচটি ব্যাংক নিয়ে একীভূতকরণ শুরু করছি, পরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও অন্তর্ভুক্ত হবে।’
তিনি জানান, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) ক্ষেত্রেও কঠোর পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠান কার্যত দেউলিয়া, যাদের খেলাপি ঋণের হার ৮০-১০০ শতাংশ। ২০টি এনবিএফআইকে শোকজ করা হয়েছে। তাদের ভবিষ্যত হবে—লিকুইডেশন বা একীভূতকরণ।
ব্যাংক খাত ঘিরে পাঁচটি প্রধান আইন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাংবিধানিক রূপান্তরের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে বর্তমানে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ আইন সংশোধন বা নতুনভাবে প্রণয়নের কাজ চলছে, যার সবকটির উদ্দেশ্য এক—খেলাপি ঋণ আদায়, ব্যাংকের স্থিতিশীলতা, এবং জনগণের টাকার অপচয় ঠেকানো।
আইনগুলো হলো—
ক. ব্যাংকরাপ্সি আইন: এই আইনটি দেশের করপোরেট দেউলিয়া প্রক্রিয়াকে আধুনিক করবে। এখন যারা খেলাপি বা দেউলিয়া হয়, তারা বছরের পর বছর লিকুইডেশন ঝুলিয়ে রাখে। এই আইনে থাকবে আগেভাগে পুনর্গঠনের সুযোগ, যাতে ক্ষতি কম হয় এবং ব্যাংকের টাকাও দ্রুত ফেরত আসে।
খ. মানি লোন কোর্ট আইন: ঋণ মামলার জটিলতা দূর করার জন্য মানিলোন আদালতের কার্যকারিতা বাড়ানো হচ্ছে। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি, নির্ধারিত সময়সীমা, এবং ব্যাংকিং সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ বিচারক নিয়োগের বিধান রাখা হবে। ইতোমধ্যে ২০২৬ সালের প্রথম প্রান্তিকের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের টার্গেট নির্ধারিত হয়েছে।
গ. ডিস্ট্রেসড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট আইন: এই আইন বেসরকারি খাতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের সুযোগ দেবে, যারা খেলাপি ঋণ কিনে তা পুনরুদ্ধার করবে। তবে সরকার স্পষ্ট করেছে—‘ব্যাড ব্যাংক’ গঠন হবে না, এবং জনগণের অর্থ দিয়ে এসব ঋণ কেনা হবে না।
ঘ. ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ: ২০২৫ সালের মে মাসে পাস হওয়া এই আইন বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে ব্যাংক বন্ধ, পরিচালনা পর্ষদ বাতিল এবং সম্পদ হস্তান্তরের পূর্ণ ক্ষমতা। এটি বাংলাদেশের প্রথম “ক্রাইসিস ব্যাকস্টপ মডেল” হিসেবে কাজ করবে।
ঙ. ডিপোজিট প্রটেকশন অধ্যাদেশ: এ আইনে আমানত বিমার সীমা দ্বিগুণ করে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি Pay Box Plus নামে একটি জরুরি তহবিল গঠন করা হবে—যা ব্যর্থ ব্যাংকের আমানত রক্ষা ও পুনর্গঠনে সহায়তা করবে।
সম্পদ উদ্ধারে টাস্কফোর্স: দুর্নীতির টাকাও ফিরিয়ে আনা হবে
বাংলাদেশ ব্যাংক গঠন করেছে অ্যাসেট রিকভারি টাস্কফোর্স, যার নেতৃত্বে থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে যুক্ত থাকবে— বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ইন্টারপোল বা এফবিআই-র সহযোগিতাও নেবে সংস্থাটি।
এই টাস্কফোর্সের দায়িত্ব—দেশের বাইরে পাচার হওয়া অর্থ খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনা, এবং দুর্নীতির মাধ্যমে জালিয়াতি হওয়া মূলধনের পুনরুদ্ধার।
আইএমএফের সহায়তা নির্ভর করছে বাস্তবায়নের ওপর
আইএমএফ-এর ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তার পরবর্তী কিস্তি এসব সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও এই উদ্যোগে সমর্থন দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ব্যাংক খাত সংস্কারের সবচেয়ে বড় ও সমন্বিত পদক্ষেপ। তবে এই উদ্যোগ সফল হবে কিনা, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক দক্ষতার বাস্তব প্রয়োগের ওপর।
আইএমএফ চুক্তি ও সংস্কারের ছয় প্রধান শর্ত
বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছ থেকে ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাচ্ছে। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংস্কারে রয়েছে ছয়টি প্রধান শর্ত: সাংবিধানিক মর্যাদা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; ব্যাংক রেজল্যুশনের পূর্ণ কাঠামো গঠন; বেসরকারি ব্যাংকের সম্পদ মান যাচাই (একিউআর);
ডিপোজিট প্রটেকশন সিস্টেম চালু; স্বচ্ছ নিয়োগ ও গভর্ন্যান্স কাঠামো এবং নিরপেক্ষ তারল্য সহায়তা কাঠামো তৈরি।
আইএমএফ এর পরবর্তী কিস্তি ছাড় করবে এই সংস্কার বাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে।
‘স্বাধীন পরিচালক ছাড়া ব্যাংক চলবে না’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অর্ধেক সদস্য স্বাধীন পরিচালক হতে হবে। একটা পরিবার থেকে তিনজনের বেশি সদস্য চলবে না। স্বাধীন পরিচালক ছাড়া কোনও ব্যাংক নিরাপদ নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংক পরিচালনা মানে শুধু মালিকানা না—এটা জনগণের অর্থ। মালিকেরা অভিভাবক মাত্র। দায়িত্ব না নিলে, দরকার হলে তাদেরও সরানো হবে।’
তিনি জানান, ইতোমধ্যে পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার কাজ চলছে, এবং প্রয়োজনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও এই প্রক্রিয়ায় আসবে। এছাড়া, ১৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যত দেউলিয়া, যাদের খেলাপি ঋণ ৮০-১০০ শতাংশ।
‘এই সংস্কার চলবে, সরকার বদলালেও নীতি বদলাবে না। যদি বদলায়, অর্থনীতি ভেঙে পড়বে’, বলছেন গভর্নর।
ব্যাংক বাঁচাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংস্কার যথেষ্ট কি?
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও আইনগত সংস্কার অবশ্যই যুগান্তকারী। কিন্তু এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে মূলত রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক দক্ষতার ওপর।
নিরপেক্ষ, যোগ্য গভর্নর নিয়োগ না হলে, কিংবা সংসদের অনুমোদন যদি শুধু ‘রাবার স্ট্যাম্প’ হয়ে থাকে, তবে এসব সংস্কার আবারও কাগজে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সাংবিধানিক মর্যাদা দিয়ে লাভ হবে না, যদি আমরা যোগ্য, স্বাধীন ও পেশাদার গভর্নর নিয়োগ না দিই। এজন্য সার্চ কমিটি ও স্বচ্ছ নীতিমালা থাকতে হবে।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাংবিধানিক রূপান্তর, আইনি সংস্কার, একীভূতকরণ ও রেজল্যুশন কাঠামো—সব মিলে এটি বাংলাদেশের ব্যাংক খাত সংস্কারের সবচেয়ে বড় ও সুসংহত প্রচেষ্টা। যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, তবে এ দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সত্যিই আধুনিক ও জবাবদিহিমূলক হতে পারে। তবে এই পদক্ষেপ সফল হবে কিনা, তা নির্ভর করবে ক্ষমতার কেন্দ্রে স্বচ্ছতা, সদিচ্ছা ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার উপস্থিতির ওপর।