অনলাইন ডেস্ক:
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সৃষ্ট দ্রব্যমূল্যের চাপ সামলাতে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মানুষ। যে হারে সঞ্চয়পত্র ভাঙা হচ্ছে তার চেয়ে কম হারে বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে আর্থিক সংকট, ব্যাংকে কম মুনাফাসহ নানা কারণে সঞ্চয় ভাঙছে মানুষ।
যদিও নিরাপত্তা ও বেশি মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে গ্রাহক। কিন্তু সুদ বেশি হওয়ার পরও সঞ্চয়পত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ২৫ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভেঙেছে গ্রাহক। অন্যদিকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সঞ্চয়পত্র কেনার হারও কমেছে ২৭ শতাংশ ।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে দেখা যায়, কেউ কেউ মেয়াদপূর্তির আগেই সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে এসেছেন। আবার কেউ কেউ এসেছেন মেয়াদপূর্তির পরে ভাঙাতে। আর কেউ এসেছেন সঞ্চয়পত্রের মাসিক বা ত্রৈমাসিক সুদ নিতে। নার্গিস আক্তার নামে সঞ্চয়পত্রের এক গ্রাহক জানান, তার স্বামী বেঁচে নেই। স্বামীর পেনশনের পুরো টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন তারা। তা দিয়েই তার পাঁচ ছেলেমেয়ের সংসার চলছিল। কিন্তু এখন আর চলছে না। এ জন্য জরুরি প্রয়োজনে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেছেন তিনি। নার্গিসের মতো অনেকেই নতুন করে সঞ্চয় করার পরিবর্তে আগে করা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন।
সঞ্চয়পত্র ভাঙার হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি গতকাল শুক্রবার ইত্তেফাককে বলেন, ‘সঞ্চয় কমে গেলে বা সঞ্চয় করা সম্ভব না হলে মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনবেন কীভাবে। এখন মানুষের আয়ের একটা বড় সংকট যাচ্ছে। একদিকে মজুরি বাড়ছে না, আরেকদিকে জিনিসপত্রের দামও ঊর্ধ্বমুখী। এ বাস্তবতায় যাদের সঞ্চয়নির্ভর জীবিকা চালাতে হচ্ছে; তারা কোনো খরচের উপলক্ষ্য আসলে সঞ্চয়ে হাত দিতে বাধ্য হন। যেমন- মেয়ের বিয়ে হতে পারে বা চিকিত্সা খরচ মেটাতে হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সঞ্চয়পত্র ভাঙানো ছাড়া আর উপায় থাকে না। তিনি বলেন, ঋণ নিতে গেলেও সুদের হার বেশি। উপায়হীন হওয়ার কারণে ঋণগ্রস্ত না হয়ে যা সঞ্চয় আছে তা দিয়ে প্রয়োজন মেটাচ্ছে মানুষ। আর আয় যদি অর্থনীতিতে না বাড়ে তা হলে অর্থ কোথা থেকে আসবে সঞ্চয়ের জন্য। মোদ্দা কথা, মূল্যস্ফীতি সঞ্চয় খেয়ে ফেলছে।’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেলার অন্যতম কারণ হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। মজুরি যে হারে বাড়ছে তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে ব্যয় বাড়ছে। সে জন্য সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে মানুষকে। এ ছাড়া অনেক ব্যাংকের ওপর গ্রাহকের বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। সামগ্রিক ব্যাংক খাতে আস্থার ঘাটতির কারণেও সঞ্চয়পত্র ভাঙার হার বাড়ছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকে আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদহারের মধ্যে তফাত্ কমে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে অনেকে বিকল্প বিনিয়োগ পণ্যে অর্থ লগ্নি করতে উত্সাহ দেখাচ্ছেন। আবার সরকার পরিবর্তনের পর অনেক সম্পদশালীর ব্যাংক হিসাব ও বিনিয়োগে নজরদারি বেড়েছে। সে কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্র ভেঙে সোনাসহ অন্যান্য বিকল্প পণ্যে বিনিয়োগ করছেন।
এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে নতুন সরকার বাড়িয়েছিল নীতি সুদহার। যদিও বাজারে তার প্রভাব খুব একটা পড়েনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাবে, টানা ১০ মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপর রয়েছে। যদিও গত জানুয়ারি মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত বছরের মার্চের পর খাদ্য মূল্যস্ফীতি আর এক অঙ্কের ঘরে নামেনি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি থাকায় গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে চাপে রয়েছেন।
সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভেঙে ফেলার পরিমাণ বেশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৩২ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙায় মানুষ। তার মধ্যে অক্টোবরে ৯ হাজার ৮৩ কোটি, নভেম্বরে ৮ হাজার ১৫০ কোটি এবং ডিসেম্বরে ৮ হাজার ৪৬১ কোটি অর্থাত্ তিন মাসে ২৫ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছেন গ্রাহকেরা। এতে করে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত বিক্রি ২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা কমে গেছে। তার আগের অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছিল ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৩০ হাজার ১০৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বিক্রি হয়েছিল ৪১ হাজার ২৯০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। তার মানে চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ১ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা বা প্রায় ২৭ শতাংশ।
এদিকে, সঞ্চয়কারীদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গত জানুয়ারিতে বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পরিবার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর এত দিন মুনাফার হার ছিল ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এখন করা হয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ। তবে বিনিয়োগের পরিমাণ সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি হলে মুনাফা হবে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা পাবেন ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। এর বাইরে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবে মুনাফার হার হবে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ।